অসমাপ্ত
অংকের খাতা ভরা থাকতো আঁকায়
তার ছবি তার নাম পাতায় পাতায়
হাজার অনুষ্ঠান প্রভাত ফেরীর গান
মন দিন গোনে এই দিনের আশায়
রাত জেগে নাটকের মহরায় চঞ্চল
মন শুধু সে ক্ষনের প্রতিক্ষায়
রাত্রির আঙ্গিনায় যদি খোলা জানালায়
একবার একবার যদি সে দাঁড়ায়…
গানের ঠিক এই লাইনগুলো আজ বারবার শুনছে রাতুল। যতবার শেষ হচ্ছে ততবার rewind করে ঠিক আবার অংকের খাতায় ফিরে যাচ্ছে। প্রথম প্রথম একটু এদিক ওদিক হচ্ছিল। কিন্তু বার দশেক পর থেকে একদম সঠিক জায়গায় আঙ্গুল টাচ করে দিচ্ছে। অংকের খাতা ভরা থাকতো আঁকায়… মনটা মাঝে মাঝেই উদাস হয়ে যাচ্ছে। বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আজ শুধু গানের এই কথাগুলোই শুনছে সে। আর নিজের মনে গুন গুন করে গেয়ে চলেছে। যতবার শুনছে তত গভীরে চলে যাচ্ছে সে, চলে যাচ্ছে আরও অতীতে।
রাতুলের আজ খুব মনে পড়ছে সেই দিনের কথা। রাতুল তখন ক্লাস নাইনে। তার দাদা’র আনা একটা পুরনো ওয়াকম্যান আর হেডফোনে সে লেখাপড়ার মাঝে মাঝে গান শোনে। রাতুলদের ঘরে টিভি নেই। রেডিও টা অনেকদিন ধরে খারাপ হয়ে পড়ে আছে। এরকম একটা জিনিস হাতে পেয়ে খুব খুশি হয়েছিল রাতুল। রাতুলের দাদা মাঝেমধ্যে একটা দুটো করে ক্যাসেট কিনে আনতো। একদিন হাতে পেলো নচিকেতার নীলাঞ্জনা। একবার শুনেই খুব ভালো লাগলো তার| এতটাই ভালো লাগছিল গানটা বারবার করে শুনছিল। যখনই গানটা শেষ হয়ে যাচ্ছে ক্যাসেট বের করে পেন দিয়ে রিলটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এই গানটার শুরুর জায়গায় নিয়ে যেত আবার প্রথম থেকে শুনতো। আজও ঠিক তাই করছে। শুধুমাত্র প্রযুক্তির পার্থক্য রয়ে গেছে। সেদিনের মতো আজও রাতুলের মনে হচ্ছে গানের কথাগুলো কতটা নিজের কতটা আপন।
বড্ড উদাস লাগছে রাতুলের। অস্থির হয়ে উঠছে। নিজের ঘর থেকে বের হয়ে ছাদের উপর চিলেকোঠার ছোট্ট ঘরটাতে গিয়ে বসল সে। ঘরটায় বেশ ধুলো নোংরা জমে আছে। এই ঘরটা ছিলো রাতুলের পড়ার ঘর। পরিষ্কার করা হয় না অনেকদিন। তবু তার মধ্যেই জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। জানালাটা খুলে দিয়ে তাকালো পাশের একতলা বাড়িটার দিকে। কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে বাড়িটা। চোখ নামাতেই চোখ চলে গেলো বন্ধ একটা জানালার দিকে| রাতুলের মনের ভিতরটা নাড়া দিয়ে উঠলো| পৃথিবীর সমস্ত শুন্যস্থান এসে এই মূহুর্তে তার বুকে ভিড় জমিয়েছে| সোজা তাকাতেই তার দৃষ্টি আটকে গেলো একটার পর একটা বাড়িতে। পরপর সব বাড়িগুলো দেখতে লাগলো জানালা দিয়ে। এক সময় বাড়ির সামনের ফাঁকা জায়গাটা জুড়ে রয়েছে এই বাড়ি গুলো| জানালার গ্রিলে কপাল ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করলো সে। ধীরে ধীরে কল্পনার জগতে প্রবেশ করছে। টাইম মেশিন ছাড়াই স্মৃতির খোঁজে একটা একটা করে বছর পিছিয়ে যাচ্ছে| ফিরে গেলো সে ঠিক বছর কুড়ি আগে। আর তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে কুড়ি বছর আগের পরিষ্কার দৃশ্য| রাতুল জানালা দিয়ে দেখতে পাছে বাড়ির সামনের ফাঁকা জায়গাটা|
পিন্টু, বাপি, ভোলা,পটলরা কেউ কেউ তার বয়সী কেউ বা বড়| আসে পাশেই থাকে সবাই| ব্যাট বল নিয়ে তারা হাজির রাতুলদের বাড়ির সামনের ফাঁকা জায়গাটায়। এটাই এদের খেলার মাঠ। তারা নিজেদের মধ্যে টিম তৈরি করছে। ছুটতে ছুটতে ঘরে ঢুকে বইয়ের ব্যাগ রেখে, স্কুল ড্রেস কোনোরকমে পাল্টে বেরিয়ে পড়ল রাতুল| কানে ভেসে আসছে ‘খেয়ে যাবি, খেয়ে যাবি কিন্তু’ মায়ের এই কথাগুলো। স্কুলের পর এইটুকু খেলার সময়। খাওয়া দাওয়া করে সময় নষ্ট করার কোনো মানেই হয়না ভাবতে ভাবতে দৌড়ে গিয়ে যোগ দিল পটলদের সঙ্গে। তাদের খেলার সরঞ্জাম তেমন যুতসই না হলেও তাদের খেলায় কোনো ভাটা পরে না| পাড়ার এক কাকু, রাস্তার ধারে ওনার কাঠের দোকান থেকে বিনা পয়সায় একটা ব্যাট বানিয়ে দিয়েছে| সবাই মিলে চাঁদা তুলে কুড়ি টাকা দিয়ে একটা ক্যামবিস বল কিনেছে। কিন্তু উইকেট আর যোগাড় হয়নি। গাছের ভাঙা ডাল দিয়েই কাজ চলে যায়। এরা সবাই মাঠে সশরীরে উপস্থিত আছে| আছে আরও একজন, যে মাঠে না থেকেও আছে| সবার সাথে নয় আছে শুধুমাত্র রাতুলের সঙ্গে| সকলের চোখের সামনে থেকেও সকলের অন্তরালে তাদের দুজনের আলাদা এক খেলা চলে।
রাতুল বারবার পাশের বাড়ির দিকে তাকাচ্ছে| কিন্তু সে যা দেখতে চাইছে তা খুঁজে পাচ্ছে না। মনের মধ্যে অনেক প্রশ্ন জেগে উঠছে| মন টা বড্ড অস্থির হয়ে উঠেছে তার| বার বার পিছনের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতে হচ্ছে তাকে। উলটো দিকে দাঁড়িয়ে ফিল্ডিং করতে চেয়েছিল রাতুল। তাহলে বারবার ঘাড় ঘোরাতে হতো না। কেউ কিছু বুঝতেও পারতো না। রাতুলের মনে হতে লাগলো ছেলেগুলো বড্ড বদ, ইচ্ছে করেই তাকে ওদিকে দাঁড়াতে দেয় না। রাতুলের আজ খেলায় মন বসছে না কিছুতেই। হাতের পাশ দিয়ে, পায়ের ফাঁক দিয়ে বল সহজেই গলে চলে যাচ্ছে। ‘কি রে কি করছিস, বলটা ধরবি তো নাকি’ পটল চেঁচিয়ে উঠলো। রাতুল তাও নির্বিকার। হঠাৎ একটা বল তার আঙ্গুল প্রায় ভেঙ্গে দিয়েই উড়ে গিয়ে পড়লো পাশের বাড়ির ছাদে। বেশ জোরে লেগেছে তার ডান হাতের শেষের আঙ্গুলটায়। বাম হাত দিয়ে আঙ্গুলটা চেপে ধরে জড়সড় হয়ে বসে পড়েছে মাঠে। কে বল আনতে যাবে তা নিয়ে শোরগোল চলছে। ‘যে মেরেছে সে যাবে’ এসব শুনতে শুনতে রাতুলের পিঠের উপর বলটা এসে পড়ল। ‘আসতে খেলতে পারোনা, মাঠ ছেড়ে বল লোকের বাড়ির ছাদে বেশি খেলা করছে|’ কথাগুলো কানে আসতেই উঠে দাঁড়ালো রাতুল। তাকিয়ে দেখল ছাদের পাঁচিলে একটু ঝুকে দাঁড়িয়ে আছে পাশের বাড়ির মেয়েটা। তাকে দেখা মাত্রই রাতুল আঙ্গুলের ব্যথার কথা ভুলে গেলো| পিঠে হাত দিয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি। অস্থির মন এখন শান্ত। এবার খেলায় মন বসেছে রাতুলের। তার হাতের পাশ দিয়ে, পায়ের ফাঁক দিয়ে বল আর বেরোতে পারছে না| কঠিন ক্যাচগুলো লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে তালুবন্দি করে নিচ্ছে সে। আর মাঝে মাঝে সবার চোখের আড়ালে একবার করে দৃষ্টি বিনিময় করে নিছে মেয়েটার সাথে| মেয়েটার ঠোঁটের কোণায় লেগে থাকা স্মিত হাসি রাতুলের খুব ভালো লাগছে| ইচ্ছে থাকলেও একদৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকতে পারছে না| খুব সতর্কভাবে সকলের নজর এড়িয়ে সে একঝলক মেয়েটাকে দেখে| এই হল রাতুলের আর এক খেলা। একটা মাঠের ভিতর আর একটা গ্যালারি তে। দুটো খেলাই সমানতালে খেলছে সে।
মাস পাঁচেক আগে রাতুলরা নিজেদের বাড়ি করে এই পাড়ায় এসেছে। রাতুল পাড়াতে এসে প্রথম যেদিন মাঠে খেলতে গিয়েছিল সেদিনই সে প্রথমবার মেয়েটিকে দেখেছিল। মেয়েটির মায়ের কড়া নির্দেশ ছিলো ওদের বাড়িতে যেন বল না যায়| ঐ বাড়িতে বল গেলে দেবে না এইরকম অর্ডার জারী ছিল। তাই ওদের বাড়িতে বল গেলে কেউ আনতেও যেতো না। দুদিন পর নিজেরাই দিয়ে দিত। পাড়ার ছেলেরা রাতুলকে প্রথম দিন পেয়ে মজা করার জন্য ইচ্ছে করে বল মেরে ওদের বাড়িতে পাঠালো| সঙ্গে রাতুলকেও। ওদের বাড়ি থেকে বল আনতে। ঐ বাড়িটার পিছনের দিকটায় খেলার মাঠটা। রাতুল বাড়ির সামনের দিকে এসে গেট খুলে বাড়ির সীমানায় ঢুকলো। একটু ভয়ে ভয়ে দরজায় টোকা দিলো। বেশ কিছুক্ষণ পর সমবয়সী একটা মেয়ে বেরিয়ে এসে চেঁচিয়ে বললো
‘কি চাই’।
‘আজ্ঞে বল, বলটা একটু দেবেন’।
আরো চেঁচিয়ে ‘আবার আপনি আজ্ঞে করা হচ্ছে। তোমার নাম কি?’
‘আমি রাতুল।’
‘ভালো নাম কি?’
‘আমার একটাই নাম।’
‘তুমি জানো না আমাদের বাড়ির দিকে বল মারা নিষেধ। আর বল এলে আমরা দিই না। দুদিন পরে পাবে যাও।’
‘আমি তো জানতাম না’ খুব নিচু স্বরে বলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রয়েছে রাতুল।
‘পড়ার সময় তো জোরে জোরে চেঁচিয়ে পড়ো আর এখন তো গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছে না’ বলেই রাতুলের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে ফেললো মেয়েটা। ভাবলেশহীন ভাবে রাতুল তাকিয়ে আছে মেয়েটার চোখের দিকে। ভারী সুন্দর চোখ মেয়েটার।
আগের চেয়ে একটু নরম স্বরে মেয়েটা জিজ্ঞাসা করল ‘কোন ক্লাসে পড়?’
‘ক্লাস নাইনে। বলটা দেবেন?’
‘না দেবো না’ মেয়েটা বলে উঠলো|
‘বল আর এদিকে আসবে না। এবারের মত দিয়ে দিন’|
‘দিতে পারি কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে পড়ার সময় ওতো জোরে জোরে পড়বে না আমার খুব ডিস্টার্ব হয়, আর আমাকে আপনি নয় তুমি করে বলবে।’
‘ঠিক আছে’ বলল রাতুল|
‘এই নাও’ বলে দিতে গিয়েও দিল না| ‘তুমি তো একা খেল না| তবে তুমি একা কেন এসেছ বল নিতে?’ বলে বলটা হাতে দিতে গিয়ে দেখল রাতুলের হাত কাঁপছে। মেয়েটা মনে মনে খুব খুশি হলো রাতুলকে ভয় পেতে দেখে। রাতুল মেয়েটার দিকে তাকিয়ে তার হাত থেকে বলটা নিয়ে প্রায় পালিয়ে গেলো। ‘এতক্ষন কোথায় ছিলি? আমরা ভাবলাম তোকে বোধহয় আটকে রেখেছিল’ পটল বলল।
‘হ্যাঁ, আটকে রেখেছিল।’ রাতুলের খুব রাগ হলো| কী বোকা সে| ছেলেগুলো তাকে নিয়ে মজা করলো সঙ্গে মেয়েটাও|
সন্ধ্যে বেলায় পড়তে বসেছে কিন্তু পড়ায় মন বসছে না রাতুলের। সেই রাগ এখনো আছে| মেয়েটা তাকে এতগুলো কথা বললো। সে চুপ করে শুনলো। রাতুল এরকমই। একটু মুখচোরা। লজ্জা তার একটু বেশিই। এসব কথা বেশি গুরুত্ব না দিয়ে পড়ায় মন দিতে চেষ্টা করলো| ক্লাস নাইনের অ্যানুয়াল পরীক্ষার বেশি দেরী নেই। পরের বছর মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে সে। চেষ্টা করলো পড়ায় মন বসাতে। কিন্তু পারলো না। ঠিক করলো আর কোনোদিন সে ওই বাড়ি থেকে বল আনতে যাবে না। ইতিহাস বই খুলে বসেছে| হলদিঘাটের প্রান্তরে মেবারের রানা প্রতাপ সিংহ মোগল বাহিনীর কাছে পরাজিত হয়ে রাজধানী চিতোর ছেড়ে পালাচ্ছেন। রাতুলের খুব ভালো লাগে ইতিহাস বিষয়টা। বিশেষ করে পরাক্রমী রাজপুত জাতির ইতিহাস। এরা হারতে জানেনা। লড়াই করতে জানে। আবার প্রতাপ সিংহ ফিরে এসে মেবারের কিছু অংশ উদ্ধার করলেন। মনটা তার ভালো হতে লাগলো। কিন্তু ভালোলাগার সাথে নম্বর পাওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। এত ভালো করে ইতিহাস পরে রাতুল, কিন্তু কিছুতেই বেশি নম্বর পায়না। নম্বর নিয়ে এখন আর বেশি ভাবে না। তার কাজ পড়া আরো ভালো করে পড়া। ভালো লেখাপড়া করে তাদের অভাবের সংসারে একটা ভালো কিছু করতেই হবে তাকে। সে বড় হয়ে সবার পাশে দাঁড়াবে। সবাই তাকে খুব ভালোবাসবে। সবাই তাকে চিনবে জানবে। এই ভাবতে ভাবতে তার পড়ার ইচ্ছেটা আবার ফিরে এলো। নিউটনের গতিসূত্র, কে কত লাভ করলো, কার কত ক্ষতি হলো, সব নিউরনের মধ্যে দিয়ে মস্তিস্কে গিয়ে স্থায়ী হলো| ‘এই খেয়ে নিবি আয়’ মায়ের ডাক। মায়ের ডাক কত আদরের হয়। ‘আসছি’ বলে নীচে চলে গেলো। খেয়ে শুয়ে পড়ল সে| চোখ বন্ধ করার সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়লো।
রাতুলের দিনগুলো ভালই অতিবাহিত হচ্ছিল। বাঁধা রুটিন| সকালে ঘুম থেকে উঠে চা বিস্কুট খেয়ে পড়তে বসা, স্নান খাওয়া সেরে স্কুল, স্কুল থেকে ফিরে বাড়ির সামনের ফাঁকা জায়গায় পাড়ার ছেলেদের সাথে খেলা, সন্ধ্যে বেলায় আবার লেখাপড়া, পড়া শেষ করে রাতে খাওয়া দাওয়া করে নিশ্চিন্তে ঘুম। বেশি সঙ্গী সাথী তার নেই। রাতুলের ভালো লাগে না বেশি হইহুল্লোর করতে। রাতুলের এই সাদামাঠা ছিমছাম জীবনযাত্রায় ছেদ পড়ল খুব শীঘ্রই| একদিন খেলতে গিয়ে রাতুলের ব্যাট থেকে বল লেগে চলে গেলো পাশের বাড়ির ছাদে। বেশ জোরেই গেছে বলটা। খেলার নতুন নিয়ম হয়েছে ওদিকে বল যে মারবে তাকেই আনতে যেতে হবে নইলে নতুন বল কিনে দিতে হবে। ঐ বাড়িতে যেতে রাতুল ভয় পায়। নতুন বল কিনে দেবার সামর্থ্যও তার নেই। রাতুলের হাত পা কাঁপতে শুরু করল। হাত থেকে ব্যাট পরে গেল। কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে ভয়ে ভয়ে গুটি গুটি পায়ে ঢুকলো পাশের বাড়ির গেট দিয়ে। দরজায় টোকা দিতে চাইছে কিন্তু পারছে না। হাত কাঁপছে তার| চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে সে| তখন তার পিঠের উপর বলটা বেশ জোরে এসে পড়লো। রাতুল বলটা হাতে নিয়ে ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখল ছাদের ওপর দাড়িয়ে সেই মেয়েটা যার কথা সে প্রায় ভুলেই গিয়েছিল| উপর থেকে রাতুলের পিঠে বল ছুঁড়ে দিয়ে রাতুলের দিকে তাকিয়ে আছে| ‘স্যরি’ বলে এক গাল হাসি দিয়ে মেয়েটা বলল ‘তোমার লেগেছে?’ রাতুল কিছু না বলে চুপ করে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকলো| কি চঞ্চল মেয়েটা অথচ তার চোখ দুটো স্থির গভীর| রাতুল এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেয়েটার দিকে| মেয়েটার চোখের দিকে| রাতুল কে এভাবে তাকাতে দেখে ‘ক্যাবলা’ বলে আরো একটু জোরে হেসে উঠলো মেয়েটা| মেয়েটাও এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাতুলের দিকে| অস্থির সমুদ্রের ঢেউ বারবার আছড়ে পরে এখন শান্ত| চঞ্চল মেয়েটা এখন শান্ত| কিন্তু তার চোখ দুটো যেন অগভীর সমুদ্র| মেয়েটার চোখের দিকে তাকিয়ে অতলে তলিয়ে যাচ্ছে রাতুল| ‘যা নিতে এসেছিলে পেয়ে গেছো তো, যাও এবার’ বলেই শান্ত সমুদ্র আবার অশান্ত হয়ে উঠলো| মেয়েটা রাতুলের চোখের দিকে তাকিয়ে হাসতে শুরু করলো| এতক্ষণ পর রাতুল নিজের ও পারিপার্শিক অবস্থানের কথা ভেবে একটু লজ্জিত হল| মেয়েটার দিকে তাকিয়েই তাদের বাড়ির সীমানা পার করে বাইরে এলো| সেই মধুর হাসি এখনও রাতুলের কানে ভাসছে|
আজ পড়ায় মন বসছে না রাতুলের। ‘যা নিতে এসেছিলে পেয়ে গেছো তো, যাও এবার’ এই কথার মানে বোঝার চেষ্টা করছে সে। কিন্তু কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না| হালকা হালকা ঠান্ডা পড়েছে। কিন্তু রাতুলের বেশ গরম লাগছে। খুব অস্বস্তি হচ্ছে। রাতুল মেঝেতে মাদুর পেতে পড়তে বসে। সে আর বসে থাকতে পারল না| উঠে ঘরের মধ্যে পায়চারী করলো| আরো গরম লাগছে তার| জানালাটা খুলে দিল। চোখের দৃষ্ঠি গিয়ে ধাক্কা গেলো পাশের বাড়িটার একটা খোলা জানালায়| সঙ্গে সঙ্গে খোলা জানালায় দাঁড়ানো একটা পরিচিত মুখ আবছা আলোতে তার চোখে ভেসে উঠলো। পরক্ষনেই যেন মুখটা সরে গেলো। মনের ভুল মনে করে অন্যদিকে একটু তাকিয়ে রাতুল আবার তাকালো ঐ জানালায়| না এবার আর কোনো ভুল নয়| এদিকে কোনো লাইট পোস্ট নেই তাই রাস্তার কোনো আলো এখানে নেই। বাড়ির জানালা দিয়ে অল্প আলো আসছে। এই অল্প আলোতেই রাতুল দেখতে পেল তার অবচেতন মনে স্থায়ী হয়ে যাওয়া পরিচিত একটা মুখ| রাতুল বুঝতে পারলো সেই পরিচিত মুখের চোখের চাওনি এখন সম্পূর্ণ অপরিচিত। পাশের বাড়ির মেয়েটা তার দিকেই তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে। মেয়েটার ঠোঁটে হালকা হাসি। অস্থির সমুদ্র আবার শান্ত | এই অস্থির সমুদ্র রাতুলের মনের মধ্যে হ্যারিকেন বইয়ে দিচ্ছে| দিনের বেলায় যে মেয়েটাকে রাতুল দেখেছে এ সে নয়, এ যেন অন্য কেউ| রাতুলের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে| আর রাতুলও একদৃষ্টে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে| ‘পড়ছিস না ঘুমিয়ে পড়েছিস’ মায়ের কথা শুনে হুঁশ ফিরল রাতুলের। তাড়াহুড়ো করে জানালা বন্ধ করে আবার মাদুরের ওপর খোলা বইয়ের সামনে বসে পড়লো। মায়ের পায়ের শব্দ শুনে সামনে খোলা বই আনমনে পড়তে লাগলো| আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলীয় অঞ্চলের তীব্র ঘূর্ণিঝড় যার গতিবেগ ঘন্টায় ১১৭ কি.মি.–এর বেশি হয় তাকে হ্যারিকেন বলে| যা এখন রাতুলের ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে| সে ভালই বুঝতে পারছে| রাতুলের মা একবার এসে দেখে গেলো। ‘আমি ঘুমাই নি , এই তো পড়ছি|’ ‘ভালো করে পর বাবা, পড়া হলে এসে খেয়ে নিবি’ বলেই মা চলে গেল। অপেক্ষাতেই ছিল রাতুল। মা চলে যেতেই জানালা খুলে দেখলো পাশের বাড়ির জানালায় । কিন্তু সেখানে তো কেউ নেই। বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো সে। যার প্রতীক্ষা সে করছিল তার দেখা আর মিললো না। জানালা বন্ধ করে খেতে গেলো সে। রাতে শুয়ে শুয়ে অনেক কিছু ভাবছে। অনেক চিন্তাভাবনা একসাথে ঘুরপাক খাচ্ছে। চিন্তা করতে করতে মস্তিষ্ক ক্লান্ত হয়ে পড়লো। ঘুমিয়ে পড়লো সে। অবচেতন মনে রাতুল দেখছে লুকোচুরি খেলা। পাশের বাড়ির মেয়েটা জানালা দিয়ে একবার করে রাতুলকে দেখছে আবার সরে যাচ্ছে। রাতুল এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে জানালার দিকে।
রাতুল পায়ে হেঁটেই স্কুলে যাতায়াত করে। দাদা বলেছে মাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করলে তাকে একটা সাইকেল কিনে দেবে। রাতুলেরও সবসময় ইচ্ছে করে একটা সাইকেল পেলে খুব ভালো হয়। সাইকেল চালিয়ে এদিক সেদিক অনেক দূর দূর যাবে সে। এসব ভাবতে ভাবতে রাতুল রাস্তার মাঝ বরাবর এসে পড়েছিল| একটা রিক্সা প্রায় গায়ের ওপর এসেই কানের কাছে হর্ন দিল| রাতুল চমকে উঠে লাফিয়ে রাস্তার ধারে সরে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। রিক্সাওয়ালার তার দিকে উঠলো ‘রিক্সা চাপা পরার ইচ্ছে হয়েছে না কি খোকা ?’ সঙ্গে সঙ্গেই রিক্সার ভিতর কে যেন যেন হি হি করে হেসে উঠলো| রাতুল কোনো উত্তর না দিয়ে চলতে শুরু করলো| আর তাকিয়ে রইলো চলন্ত তিনটে চাকার দিকে| একটু ওপরের দিকে তাকাতেই তার চোখে পড়ল রিক্সার পিছনদিকের ছেড়া পর্দা সরিয়ে একজোড়া চোখের দৃষ্টি তার দিকে| মুখটাও অল্প অল্প দেখা যাচ্ছে| ঠোঁটের কোনায় স্মিত হাসি| এই হাসি তার খুব চেনা হয়ে গেছে| পাশের বাড়ির মেয়েটিকে রাতুলের চিনতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হলো না| সেও স্কুলে যাচ্ছে। রাতুল মেয়েটির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে যতই এগিয়ে যাচ্ছে আছে ততই যেন সেই হাসি দূরে সরে যাচ্ছে। রিক্সা রাতুলের দৃষ্টিগোচরের বাইরে চলে যাচ্ছে| এখন শুধু রিক্সাটা দেখা যাচ্ছে| আর রাতুলের চোখে ভেসে উঠলো রিক্সার পিছনে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা “আবার দেখা হবে”| আবার তার মনে হলো একটা সাইকেল খুবই দরকার। স্কুল থেকে ফেরার পথে তার পাশ দিয়ে যখনই কোনো রিক্সা চলে যাচ্ছে একবার আড়চোখে তাকিয়ে দেখে নিচ্ছে| একবার যদি দেখতে পায়| আশা তার পূরণ হলো কিন্তু রাস্তায় নয়| বাড়ি ফিরে খেলার মাঠে খেলতে গিয়ে| রাতুল আজ এমন জায়গায় দাঁড়িয়েছে যাতে সে সরাসরি মেয়েটাকে দেখতে পায়| অল্প কিছুক্ষণের প্রতীক্ষা তারপরেই মেয়েটা এসে ছাদে দাড়িয়েছে| আপন মনে ছাদে পায়চারী করছে| রাতুল মাঝে মাঝেই তাকিয়ে দেখছে মেয়েটাকে| কিন্তু মেয়েটা রাতুললের দিকে তাকাচ্ছে না| রাতুলও তাকানো বন্ধ করে খেলায় মন দিয়েছে| বেশ কিছু সময় বয়ে গেছে| রাতুলের চোখ আবার চলে গেলো ছাদের উপরে| দেখল মেয়েটা তার দিকে তাকিয়ে আছে আর তার ঠোঁটের কোণায় স্মিত হাসি| রাতুলের চোখে মুখে হাসির ঝলক| মেয়েটা আবার পায়চারী করতে লাগল| রাতুলও খেলায় ব্যস্ত| তবে মাঝে মাঝেই দুজনে দৃষ্টি বিনিময় করে নিচ্ছে সঙ্গে একটু হাসি| সেই শুরু লুকোচুরি খেলার| দুজনেই খুব সতর্ক সকলের সামনে থেকেও তারা যেন সবার অগোচরে।
শুরু হয়ে গেলো সমবয়সী দুটো ছেলেমেয়ের মনের খেলা। স্কুলে যাওয়ার পথে বা ফেরার সময়, কখনো জানালায়, কখনো বা বাড়ির ছাদে, নয়তো খেলার মাঠ থেকে দুজনের মন দেওয়া নেওয়া চলতে থাকলো। মেয়েটা বাইরে একা একা কখনো যায়না| সবসময়ই হয় তার বাবা নয় মা কেউ না কেউ সঙ্গে থাকে| ইচ্ছা থাকলেও এখনো অবধি তাদের সামনাসামনি কথা হয় নি। সামনে কথা বলতে রাতুলের কেমন যেন ভয় ভয় করে| কথাবার্তা ইশারাতেই হয়। বিশেষ করে সন্ধ্যের পর জানালা দিয়ে। প্রথম প্রথম অসুবিধা হলেও সে ভাষা তারা রপ্ত করে নিয়েছে। দুজনেরই মনে হতে থাকে ভালোবাসা বহিঃপ্রকাশের জন্য ভাষাটা কোনো বাধাই নয়| কেউ কাউকে সরাসরি বলতে না পারলেও আকার ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছে দুজন দুজনকে ভালবাসে| সময়ের সাথে সাথে দুজনের মধ্যে ভালবাসা বাড়তে লাগলো| আর ভালবাসার প্রতি আকর্ষণ যত বাড়তে লাগলো লেখাপড়ার প্রতি আকর্ষণ ততই কমতে থাকলো| পৃথবীতে সব কিছুই ধ্রুবক। কোথাও কিছু একটা একটু বাড়লে অন্য কোথাও অন্য কিছু একটা কমে| সকালের দিকে প্রায় রোজই স্যার মেয়েটিকে পড়াতে আসেন| তাই দেখা হয় না| আর রাতুল ব্যস্ত থাকে নিজের লেখাপড়া নিয়ে| পড়া কম হয় লেখা বেশি, কিন্তু বোঝার উপায় নেই| অঙ্কের সাদা খাতার পাতায় কোথাও কোথাও নিজের মনের প্রতিচ্ছবি আবার কোথাও কবিতা লেখার প্রচেষ্টা| মস্তিস্কের চিন্তাভাবনা বোঝা যায় কিন্তু মনের চিন্তাভাবনা লেখা গেলেও বোঝা সহজ হয়না| একমাত্র লেখকই বোঝে সাদা খাতা ভর্তি লেখার মনের লেখার অর্থ। মেয়েটার নাম এখনো জানতে পারেনি রাতুল| জানার চেষ্টাও করেনি| অন্য কারোর থেকে জানার ইচ্ছেও তার নেই| তার মনে হয় যার নাম তার থেকে শুনতেই বেশি ভালো লাগবে| সে অপেক্ষায় আছে, তার অনামিকার প্রতিক্ষার অবসান একদিন ঘটবে|
স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার তাড়া রাতুলের এখন নেই| দূরত্ব একই আছে কিন্তু সময় দীর্ঘায়িত হয়েছে। ফিরতি পথে যদি একবার দেখা হয়, যদি একটু কথা হয় তার সাথে। দেখা মাঝে মাঝে হলেও কথা হয় না| খেলার মাঠের বিকেল বেলাটা তার কাছে তাড়াতাড়ি সন্ধ্যে ঘনিয়ে আসে| দুজনেই অপেক্ষা করে সন্ধ্যের| সন্ধ্যের সময়টা যেনো আরও তাড়াতাড়ি অতিবাহিত করে রাত নেমে আসে| জানালা বন্ধ হয়| খাওয়ার পর শুয়ে শুয়ে অলীক কল্পনার জাল বুনতে থাকে রাতুল| প্রবেশ করে স্বপ্নের জগতে| রাতুলের দাদা রাতুলকে সাইকেল কিনে দিয়েছে| স্কুলে যাবার সময় একটু আগে বেরিয়ে রাস্তায় ধারে লুকিয়ে অপেক্ষা করে| রিক্সা করে মেয়েটা সামনে এলেই এমন ভাব করে যেন আকস্মিক দেখা| মেয়েটাও এখন তার কার্য কলাপ সম্বন্ধে অবগত| হাসি মুখে না বলা কথার উত্তর দিয়ে দেয়| তারপর রিক্সার পাশাপাশি যাওয়ার চেষ্টা করে| স্বপ্নের আরো গভীরে চলে যায় সে| রাতুল মেয়েটিকে সাইকেলে বসিয়ে মাঝে মাঝে স্কুলের সামনে নামিয়ে দিয়ে যায়| একদিন তাড়াতাড়ি স্কুল ছুটির পর সে মেয়েটির সাথে ঘুরতে বেরিয়েছে| সাইকেলে চলেছে অজানার উদ্দেশ্যে| হঠাৎ মেঘ কালো করে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দিল তাদের| বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে সাইকেলে করে বাড়ির পথে ফিরছে দুজনে| বেশ জোরেই ছুটে ছলেছে তার সাইকেল। হঠাৎ সজোরে ব্রেক করতেই সামনের ছাতা মাথায় দেওয়া লোকটা তাদের দিকে ঘুরে তাকাতেই ভয় পেয়ে জেগে উঠে রাতুল। তার বুকটা ধড়ফড় করে ওঠে| স্বপ্ন সত্যি নয় এই ভাবনায় মনকে শান্ত করে। রাতুল আবার চোখ বন্ধ করে স্বপ্ন দেখবার আশায়। মনে মনে ভাবে মেয়েটির বাবার সামনে আর যেন না পড়তে হয়। ভাবতে ভাবতে গভীর ঘুমে আছন্ন হয়ে পড়ে সে।
পাড়ার ছেলেপিলেরা মিলে সরস্বতী পূজো করবে বলে ঠিক করল। রাতুলও তাদের সাথে যোগ দিল। শুরু হয়ে গেল প্রস্তুতি। চাঁদা তোলা থেকে শুরু করে প্যান্ডেল তৈরির সরঞ্জাম কেনা, ঠাকুরের বায়না দেওয়া| খেলার মাঠের একপাশে শুরু হলো প্যান্ডেল তৈরির কাজ| সব কিছু ব্যস্ততার মাঝেও রাতুলের চোখ চলে যায় জানালায়| রাত জেগে প্যান্ডেল তৈরি করতে করতে অর্ধেক খোলা জানালায় দাঁড়িয়ে থাকা অনামিকা কে দেখতে পায়। রাতুলের সব কিছুর মধ্যেই একাত্ম হয়ে রইল তার অনামিকা। কাছে থাকতে না পারলেও মেয়েটি সর্বদা রাতুলের পাশেই আছে। কথা না হলেও চোখের ভাষাতে দুজনের ভাব বিনিময় হয়| তাদের বাড়িতে পুজোর চাঁদা আনতে গিয়ে রাতুল জানতে পেরেছে মেয়েটি তারই ক্লাসে পড়ে। কিন্তু নামটা কিছুতেই জানতে পারল না| রাতুল খুব আশা করে আছে পুজোর দিন মেয়েটা নিশ্চয়ই স্কুলে যাবে| তখন দেখা করবে| প্রথমবার সামনাসামনি কথা হবে| তার কল্পনা বাস্তবের ছোঁয়া পেল না। পুজোর দিন একবারও সে তার অনামিকাকে দেখতে পেল না| পুজোর পরের দিন রাতুলদের স্কুলে খাওয়া দাওয়া। খুব মজার দিন। কত যত্ন করে স্যার ম্যামরা নিজেদের হাতে ছাত্রদের পাতে খাবার দেন। খিচুড়ি, বাঁধাকপি, চাটনী আর মিষ্টি| রাতুলের খুব ভালো লাগে একসাথে লাইন দিয়ে বসে খেতে। স্কুল থেকে ফেরার পথে রাতুলের মন খারাপ হতে লাগলো| দুটো দিন আনন্দের মধ্যেও মেয়েটিকে সে প্রতিমুহূর্তে তার ছায়াসঙ্গী ভেবেছে। এই দুই দিনে একবারও সে মেয়েটির দেখা পায় নি| খোলা জানালাও তার কাছে বন্ধ বলে মনে হয়েছে। রাতুল নিজেকে একাকী অনুভব করতে লাগলো। বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে রাতুলের মনে আশার আলো আবার প্রজ্বলিত হতে লাগলো। দেখতে পেল মেয়েটিকে| সঙ্গে দুই বান্ধবী। একসাথে হেঁটে যাচ্ছে তারা। রাতুল তাড়াতাড়ি একটু এগিয়ে যেতেই তাদের মধ্যে একজন বলে উঠলো উঠল ‘এবার যেতে পারবি তো নীলাঞ্জনা? এবার আমরা আসি!’ ‘হ্যাঁ পারবো’ বলে মেয়েটি ঘাড় ঘুরিয়ে বান্ধবীদের বিদায় জানাতেই রাতুলকে দেখতে পেলো। দেখেই চমকে উঠলো| রাস্তার তিন মাথার মোড়ে পরস্পরের থেকে প্রায় হাত পাঁচেক দূরে দাঁড়িয়ে দুজন। দুজনের চোখে মুখে কৌতূহলের ছায়া সরে গিয়ে হাসির প্রকাশ। চোখে চোখ রেখে ভাবের বিনিময় ছলছে। ইশারার ভাষা আয়ত্ত করে মুখের ভাষার ব্যবহার তারা ভুলে গেছে। যা কিছু বলার দুই চোখ যেন বলে ছলেছে। সাইকেলের ক্রিং ক্রিং শব্দে হুশ ফিরল দুজনের। আর দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক হবে না ভেবে মেয়েটি পা বাড়াতেই রাতুল আসতে আসতে বলে উঠলো “নীলাঞ্জনা”.. সাথে সাথেই মেয়েটি রাতুলের দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে রাতুলের অনামিকাকে নীলাঞ্জনা ডাকার সম্মতি জানিয়ে দিয়ে চলে গেল। সদ্য প্রস্ফুটিত ভালোবাসার অঙ্কুর যেন কারোর নজরে না পড়ে ভাবতে ভাবতে রাতুল বাড়ি ঢুকল। রাতুলের আনন্দের সীমা রইলো না| আর অনামিকা নয়.. নীলাঞ্জনা| বাড়ি ফিরে হেডফোন কানে গুঁজে ওয়াকম্যান চালিয়ে শুনতে লাগলো.. সে প্রথম প্রেম আমার নীলাঞ্জনা।
সীমাহীন ভালোবাসায় ভেসে চলেছে দুটি মন। ঘরের মধ্যে আবদ্ধ থেকে কখনো জানালায় বসে কখনো ছাদে দাঁড়িয়ে চোখের ভাষায়, ইশারায় বা কখনো মনের আয়নায় পরস্পরের কাছেই আছে তারা দুজনে| তারা হারিয়ে যায় জানা অজানার প্রান্তে, হাত ধরে হেঁটে যায় মাইলের পর মাইল, কখনো সবুজে ঘেরা পথের প্রান্তে এসে গাছের ছায়ায় বসে আবার কখনো আবার বৃষ্টি ভেজা গাছের তলায় আশ্রয় নেয়। এতদিনের না বলা কত কথা যেন কথামালা হয়ে যায়। একজন বলে অন্যজন শোনে, কিন্তু বেশির ভাগ সময় দুজনেই বলছে আর দুজনেই শুনছে। আশপাশের শব্দে যখন ঘোর কাটে দুজনেই চমকে উঠে। তাদের মনে হয় অজানার জগৎ থেকে সবেমাত্র ফিরে এসেছে তারা আর এখন বিদায় জানিয়ে ঘরে ফেরার পালা। একই সাথে দুজনে দুজনের চোখে চোখ রেখে যেন বলে যায় ‘আসছি’| চোখের ভাষা আজ তাদের যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। চোখের ভাষার এই টাইমিং তাদের অনেকদিনের রপ্ত। এখন আর একটুও এদিক ওদিক হয় না। এক সঙ্গে আন্দোলিত হয় তাদের হৃদয়ের কম্পন। তাও যেন চোখের ভাষায় বুঝতে পারে তারা। সেই কম্পনে অনুনাদ সৃষ্টি করে সুরের ছন্দপতন ঘটলো। ক্লাস নাইনের পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে। দুজনেই খুব খারাপ রেজাল্ট করেছে। কোনোরকমে পাশ করেছে দুজনেই। বাড়ি থেকে খুব করে বকাঝকা করেছে দুজনকেই। খুবই মন খারাপ আজ দুজনের। কেউই আর জানালার ধারে আসতে চাইছে না অথচ দুজনেই দুজনের প্রতিক্ষায়। অবশেষে প্রতীক্ষার অবসান। সন্ধ্যের অনেক পর জানালায় উঠা এতদিনের ঝকঝকে নক্ষত্র দুটি আজ যেন আলোকশূন্য। বিষণ্ণ দুটো মুখ আজ আবছা আলোর মতই অস্পষ্ট। চোখে চোখ রাখতেই অঝোরে বৃষ্টিধারার মতো ঝরে পড়লো চোখের জল। সব বাধা পেরিয়ে ছুটে যেতে চাইছে দুজন দুজনের কাছে। চোখের জল বাঁধ ভেঙে পৌঁছে গেল একে অপরের কাছে। চোখের ইশারায় পরস্পরকে বুঝিয়ে দিচ্ছে নিজেদের কৃতকর্মে দুজনেই অনুতপ্ত। চোখের ভাষা ধীরে ধীরে কঠিন থেকে কঠিনতর হতে লাগলো। কেউ কারোর ইশারার ভাষা বুঝতে পারছে না। অস্পষ্ট এক বার্তা তাদের কপালে চিন্তার বলিরেখা এঁকে দিয়ে গেলো।
রাতুল ও নীলাঞ্জনা কোনরকমে পাশ করে ক্লাসে টেনে উঠেছে। রাতুল অনেক চেষ্টা করেছে তার সাথে দেখা করার কথা বলার কিন্তু সফল হয়নি। নীলাঞ্জনার সাথে হয়তো বাবা নয়তো মা কেউ না কেউ সবসময়ই থাকে। বাইরেও বেশি বের হয়না। রাতুল ভয়ে কাউকে এই বিষয়ে কিছু বলতে পারে না। নীলাঞ্জনা কে সে গোপন করেই রাখতে চায়। জানালা খোলা থাকলেও তাকে আর দেখতে পায় না সে। দিন গুলো তার কাছে দুঃস্বপনের মতো লাগে। কোনো কিছুই আর ভালো লাগে না তার। না বাড়ি না স্কুল। পাশের মাঠে খেলতে যাওয়াও বন্ধ করে দিয়েছে সে। রাতুলের খুব প্রিয় একটা জায়গা আছে| মনের দুঃখ কষ্ট আনন্দ ভাগ করে নিতে সেই খানে গিয়ে বসে থাকে। তাদের বাড়ির কাছাকাছি এয়ারপোর্ট। এয়ারপোর্টের সীমানা পার করে পাশেই পিচ রাস্তা| পিচ রাস্তার শেষে এক মেঠো পথ। পথের দুদিকে ফাঁকা সবুজ ঘাসে ঢাকা প্রান্তর, বড় একটা পুকুর আর পাশেই সবুজ ঘাসে ঢাকা একটা বড় মাঠ। মাঠের একধারে এক বিশাল বটগাছ। বিকেলের দিকে দাদার সাইকেলটা পেলেই ওখানে গিয়ে বসে থাকে রাতুল। আর প্লেনের উঠানামা দেখতে থাকে। সন্ধ্যে হলে ফিরে আসে। চেষ্টা করে ভালো করে পড়তে কিন্তু কিছুতেই পড়তে তার আর মন বসে না। বইয়ের পাতার মাঝে নীলাঞ্জনার সেদিনের দুই চোখের ভাষা পড়তে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। আশাই এখন তার ভরসা।
হঠাৎ একদিন নীলাঞ্জনা তার এক বান্ধবীকে দিয়ে রাতুলের কাছে খবর পাঠিয়েছে। বলেছে আজ স্কুলছুটির পর স্কুলের পিছনের রাস্তায় তার সাথে পাঁচ মিনিটের জন্য দেখা করতে| রাতুল আজ স্কুলে যাওয়ার পথে খবরটা পাওয়ার পর থেকেই কখনো আনন্দে আবার কখনো দুঃশ্চিন্তায় ডুবে যাচ্ছে। বারবার ভাবছে নীলাঞ্জনা তাকে কি বলতে পারে! চিন্তায় চিন্তায় তার চিন্তা করার ভাবনাটাই চলে গেল। তার মনে পড়ে গেল তিন দিনের আগের একটা ঘটনা। সেদিন নীলাঞ্জনা তার মায়ের সাথে ফিরছিল| রাতুলকে দেখেছিল ঠিকই কিন্তু একবারও রাতুলের দিকে তাকায়নি পর্যন্ত। অনেক চিন্তা মাথায় নিয়ে রাতুল দেখা করতে গেল। নীলাঞ্জনা আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল। ‘তুমি কেমন আছো’ প্রায় দুজনেই একসাথে বলে উঠলো। কেউ কোনো উত্তর না দিয়ে দুজনে দুজনের চোখের দিকে তাকালো। কিন্তু চোখের ভাষা খুব অচেনা হয়ে গেছে| কেউই কিছু বুঝতে পারলো না। নীলাঞ্জনা কথা বলতে শুরু করল ‘খুব ভয় ভয় করছে কেউ যদি দেখে নেয়! মা আজ নিতে আসতে পারবেনা। তাই দেখা করতে পারলাম। বেশিক্ষন কথা বলতে পারবো না। যা বলছি মন দিয়ে শুনবে আর সেইমত কাজ করবে। সামনের বছর আমরা দুজনেই মাধ্যমিক দেবো। ভালোভাবে পড়াশোনা করে দুজনকেই ভালো রেজাল্ট করতে হবে| আর সময় নষ্ঠ নয় আজ থেকেই শুরু করবে| রাস্তায় আমাকে দেখে বেশি তাকাবে না। মা বুঝতে পারবে। আমার জন্য খুব কষ্ট পেয়েছ বলো? আমি সবসময় তোমার পাশেই আছি| আমাকে নিয়ে একটুও চিন্তা করবে না। তুমি খুব ভালো করে পড়াশোনা করবে| খুব ভালো রেজাল্ট করবে। যেদিন মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরোবে সেদিন আমরা বাইরে দেখা করবো। তুমি পারবে তো?’ ‘এই চলে আয়, তোর রিক্সা কাকু চলে এসেছে’ তার এক বান্ধবীর ডাক শুনে নীলাঞ্জনা তাড়াতাড়ি চলে যেতে লাগলো| যেতে যেতে আবার রাতুলের দিকে তাকিয়ে আছে। রাতুল আবার সেই চোখের ভাষা বুঝতে পারছে। নীলাঞ্জনা যেন বারবার বলছে তুমি পারবে তো.. তুমি পারবে তো.. আর রাতুল নীলাঞ্জনার চোখের দিকে তাকিয়ে বলছে আমি পারবো..আমি পারবো..। ‘এবার থেকে আবার জোরে জোরে চেঁচিয়ে পড়বে’ বলেই নীলাঞ্জনা হাসি মুখে আরো দ্রুত চলে গেলো। রাতুল তার দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকলো।
দুজনের চোখেমুখে এখন প্রত্যয় আর প্রতিজ্ঞার দৃঢ়তা। স্বপ্ন পূরণের অঙ্গীকার। এখন আর প্রতিদিন দুজন দুজনকে দেখে না| খোলা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এখন আর সময় নষ্ট কেউই করে না। মাঝে মধ্যে দেখা হয় খুব অল্প সময়ের জন্য| কল্পনা তে নয় বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে আগামী ভবিষ্যতের স্বপ্নের ইমারত তৈরি করবে তারা। মজবুত ভিত তৈরির প্রস্তুতি চলছে| এবার একটু একটু করে দুজনে মিলে সেই স্বপ্নের ইমারতকে বাস্তবায়িত করবে| মাঝে মধ্যেই দুজন দুজনকে পরীক্ষা করে নেয় পড়াশোনা ঠিকঠাক হচ্ছে তো। নিজেরাই নিজেদের ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। প্রতিমুহূর্তে আরো ভালো করার প্রচেষ্টা। দুজনের মধ্যে শুরু হয়েছে এক সুস্থ প্রতিযোগীতা। কে কত ভালো রেজাল্ট করতে পারে। দুজনের কারোর আর কোনো চিন্তা নেই। সময় যত এগিয়ে আসছে পড়ার গতি তত বাড়ছে। টেস্ট পরীক্ষায় দুজনেই মোটামুটি রেজাল্ট করেছে। তারপর শুধু পড়া আর পড়া। আর সারাদিনের মাঝে পাঁচমিনিট তাদের দেখা। সব কিছু যেন সাজানো বাঁধানো নিয়মে চলছে। মাধ্যমিক পরীক্ষা আসন্ন। প্রথম পরীক্ষার আগের দিন ছাদে চোখের ভাষায় দুজন দুজন কে ‘বেস্ট অফ লাক’ জানিয়ে দিল। দুজনের হাসিমুখে টেনশনের স্পষ্ট ছাপ রয়ে গেল। রাতুল সন্ধ্যের দিকে একটু বইপত্র নিয়ে বসল। পেন গুলো চেক করে নিলো। তারপর ডাইরি তে লেখা পরীক্ষার রুটিনটা নিয়ে বসলো। রুটিন দেখার পর রুটিনের সাথে স্টেপল করা একটা সাদা কাগজে নিজের একটা লেখা একবার পড়ে নিল।
প্রিয় নীলাঞ্জনা,
আমি সেদিন তোমায় কোনো কথা বলতে পারিনি। আশা করি তুমি আমাকে দেখে বুঝতে পেরেছো যে আমি ভালো করেই লেখাপড়া করছি। তুমি আমার সঙ্গে আছো এটাই আমার অনেক পাওয়া। কথা দিলাম মাধ্যমিকের রেজাল্ট এর দিন আমরা হাসিমুখে দেখা করবো। তুমিও ভালো করে লেখাপড়া করো। তুমি ভালো থেকো।
আমার ভালোবাসা নিও।
ইতি রাতুল।
মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরোনোর আগের দিন বিকেলে ছাদে দেখা হল দুজনের। দুজনের চোখের ভাষা স্পষ্ট বলে দিচ্ছে চিন্তা নেই কাল আমাদের দেখা হচ্ছে। কল্পনার বাস্তবায়ন হল। দুজনেই আশি শতাংশের ওপর নম্বর পেয়ে মাধ্যামিক পাশ করেছে। ক্লাস নাইনে খারাপ রেজাল্ট করার সব দুঃখ কষ্ট মুছে দিয়েছে তারা। বাড়ির হইচই আনান্দের মাঝেও অপেক্ষা করছে সেই কাঙ্খিত শুভ মহরতের। জানালায় দাঁড়িয়ে সময় ঠিক করে নিয়েছে। বিকেল পাঁচটায় রাস্তার তিন মাথার মোড়ে তাদের দেখা হল। পাড়ার মধ্যে থাকায় কেউ কারোর সাথে কথা না বলে অনেকটা দূরত্ব রেখে হাঁটতে লাগলো। রাতুল আগে আর পিছনে নীলাঞ্জনা। পাড়া থেকে যতই দূরে যাচ্ছে তাদের মধ্যেকার দূরত্ব ততই কমছে। এখন তারা পাশাপাশি হাঁটছে। মাঝে মাঝেই দুজনের হাতে হাতে ছোঁয়া লাগছে। আজ কতদিনের না বলা সব কথা কথামালা হয়ে ঝরে পড়ছে। হাঁটতে হাঁটতে তারা একটা মাঠের একপাশে বড় বাঁধানো একটা পুকুরের পাড়ে এসে পৌঁছেছে। পুকুরের বাঁধানো ঘাটের সিঁড়িতে বসলো তারা। রাতুল পকেট থেকে মিষ্টি বের করে নীলাঞ্জনার মুখের সামনে ধরল। নীলাঞ্জনা অর্ধেকটা নিয়ে বাকিটা রাতুলের মুখে দিয়ে দিলো। একটা বছর পরিশ্রম করে আগামী ভবিষ্যতের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করতে পেরে দুজনেই আজ খুব খুশি। আর কোনো বাঁধাই তাদের চলার পথে কাঁটা হতে পারবে না। দুজনেই আজ পরিণত। কোনো তাড়াহুড়ো নয়, জীবনে চলার পথে উন্নতির প্রতিটা ধাপ খুব সন্তর্পণে পা ফেলে ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে চায় দুজনেই। তারা চায় তাদের এই সাফল্যের ধারাবাহিকতা যেন আগামী দিনের পরীক্ষা গুলোতেও থাকে। কল্পনার জগতে নয় বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে থেকে নিজেদের চলার পথের রাস্তা নিজেরাই তৈরি করবে। রাতুল নীলাঞ্জনার হাতে পরীক্ষার রুটিনের সাথে স্টেপল করা ছোট্ট চিঠিটা দিল। লেখাটা পড়ে নীলাঞ্জনা একদৃষ্টে রাতুলের দিকে তাকিয়ে আছে। আর তার মুখে প্রথম দিনের সেই মায়াবী দৃষ্টি। চারদিক অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। মাঠও ফাঁকা হতে শুরু করেছে। দুজনে দুজনের খুব কাছে এসে হাত ধরে বলে উঠলো ‘পাশে আছি পাশেই থাকবো’। তারপর দুজনেই উঠে পড়লো। যে পথে যাওয়া সেই পথেই ফিরে আসা। চলতে চলতে নীলাঞ্জনা রাতুলের হাত ধরে বলল ‘তোমার বিজ্ঞান আর আমার সাহিত্য’। রাতুল মনে মনে ভেবেছিল দুজনেই বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হলে একসথে টিউশন পড়তে যেতে পারতো, মাঝে মাঝে পড়তে যাওয়ার নাম করে দেখা করে একটু ঘুরে আসতে পারতো। কিন্তু তা আর হল না। রাতুল নীলাঞ্জনার হাত নিজের হাতে রেখেই বলল ‘সাহিত্য ছাড়া বিজ্ঞান অসম্পূর্ণ’। নীলাঞ্জনার সেই মধুর হাসি অনেকক্ষণ পর আবার ফিরে পেলো রাতুল। পাড়ার কাছাকাছি আসতেই আবার তাদের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে লাগলো। দেখা হল রাত দশটায় জানালায়। আজ আর কোনো আলোর প্রয়োজন নেই তাদের। জানালার পাশে একবছর আগে নিভে যাওয়া নক্ষত্র দুটি নিজের আলোয় আলোকিত।
আজ রাতুলের খুব আনন্দের দিন। রাতুলের দাদা রাতুলকে সঙ্গে করে নিয়ে গেছে ওর পছন্দের সাইকেল কিনে দেবে বলে। রাতুল আগেই নীলাঞ্জনাকে বলে রেখেছিল এই দিনটাতে তার সাথে দেখা করবে। নীলাঞ্জনা সকাল থেকেই জানালা দিয়ে বার বার করে কিছু একটা বলতে ছেয়েছে। রাতুলের দাদা এত তাড়াহুড়ো করছিলো যে রাতুল বুঝতেই পারল না নীলাঞ্জনার কথা। তবে রাতুল নীলাঞ্জনাকে আশ্বস্ত করেছে আর তো কিছুক্ষণের অপেক্ষা তারপরই দেখা হবে তাদের। কিন্তু সাইকেলের দোকানে প্রায় সারাদিন কেটে যাওয়ায় দেখা করতে পারেনি। সাইকেলের দোকানে সমবয়সীদের ভিড় দেখে রাতুলের মনে কৌতুহল হলো তার মত এরাও বোধহয় মাধ্যমিক পাশ করেছে। এদের দাদারাও বোধহয় বলেছিল মাধ্যমিক পাশ করলে সাইকেল কিনে দেবে। সব দাদা’রা হয়তো এমনই হয়। নিজের সাইকেলটা ভালো করে দেখে নিচ্ছে রাতুল| আর ভাবছে রেজাল্টের দিন তারা বেশিদূর যেতে পারেনি| আজ সাইকেলে চাপিয়ে নীলাঞ্জনা কে নিয়ে ঘুরবে। তাকে চমকে দেবে রাতুল। নীলাঞ্জনাকে সাইকেলে বসিয়ে তার পছন্দের জায়গাতে নিয়ে যাবে এসব ভেবেই রাতুল সকাল থেকেই খুব আনন্দের মধ্যে আছে। ঠিক করেছে বিকাল পাঁচটায় দেখা করবে। পাড়া থেকে বেরিয়ে একটু দূরে ঐ জোড়া পাঁচিলের কাছে বট গাছটার তলায় ভাঙা মন্দিরটার সামনে দেখা হবে তাদের। সাইকেল কিনে বাড়ি ফিরতেই চারটে বেজে গেলো। বাড়ি ফিরে স্নান খাওয়া সেরে অপেক্ষা করতে লাগলো সেই সময়ের। পৌনে পাঁচটা বাজে। সাইকেলটা আর একবার ভাল করে মুছে নিল রাতুল। রাংতায় মোড়া গোলাপি গোলাপটা সযত্নে জামার বুকপকেটে নিয়ে সে বেরিয়ে পড়লো। সাইকেল কিনে ফেরার সময় রাতুল এই গোলাপটা কিনে এনেছে। রতুল স্বপ্নের বাহনে বসে আর এক স্বপ্ন বাস্তবায়িত করতে যাচ্ছে। রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে লোকের চোখের দিকে তাকাচ্ছে আর নিজের সাইকেলের দিকে। যেন তাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে দেখো আমার পক্ষীরাজ। রাতুল পৌঁছে গেলো ভাঙা মন্দিরের সামনে। রাতুল নিশ্চিত এখনো পাঁচটা বাজেনি। অনেকক্ষন হলো রাতুল অপেক্ষা করছে। নীলাঞ্জনা এখনও আসেনি। রাতুল মনে মনে ভাবছে আজ দেরি হলেও কিছু অসুবিধা নেই পক্ষীরাজ আছে তার কাছে। অনেকটা সময় অতিবাহিত হয়ে গেলো। সময় যত বাড়তে লাগল রাতুলের টেনশনও পাল্লা দিয়ে বাড়তে লাগলো। এই বুঝি আসবে ভেবে ভেবে সন্ধ্যে ঘনিয়ে এলো। কিন্ত কই! এখনো তো এলো না নীলাঞ্জনা। অস্থির হয়ে উঠেছে রাতুল। বুকের মধ্যে কিছু একটা আটকে গেছে তার। দমবন্ধ হয়ে আসছে রাতুলের। ধীরে ধীরে চারিদিক গাঢ় অন্ধকারে ডুবে গেল। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকতে রাতুলের অল্প ভয়ও করছে। সাইকেল নিয়ে হাঁটতে শুরু করল। আর মাথা ভর্তি হতে লাগলো আকাশ পাতাল চিন্তায়। সে কেন এলো না? সে ঠিক আছে তো? কিছু হয়নি তো তার। রাতুলের মনে পড়লো সকালে নীলাঞ্জনা বারবার করে কিছু বলতে চাইছিল। রাস্তায় লোকেদের থেকে জানতে রাত 8 টা বাজে। আর অপেক্ষা করার মানে হয় না। একরাশ উৎকণ্ঠা নিয়ে বাড়ি ফিরে এলো রাতুল। জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। অনেক সময় দাঁড়িয়ে রইলো সে। রাতুল ভাবতে ভাবতে এসেছে নীলাঞ্জনার ঘর থেকে ভেসে আসা আলোররেখা তার মনের অন্ধকারকে দূর করে দিয়ে নীলাঞ্জনা আবার জানালার পাশে এসে দাঁড়াবে। কিন্তু এই প্রতীক্ষার অবসান হলো না। রাতুল নীচে নেমে এসে বসলো কখন বিছানায় শুয়ে পড়লো। ক্লান্ত বিধ্বস্ত অস্থির অশান্ত রাতুল। এই কয়েক মুহূর্তেই সবকিছুই কেমন যেন বিস্বাদ হয়ে গেছে রাতুলের। দিগ্বিদিক জ্ঞান শুন্য। রাতুলের মা ঘরে এসে আলোটা জ্বালাতেই রাতুল সাথে সাথে আলোটা বন্ধ করে দিতে বলল। অন্ধকারে নিজের একাকীত্ব কম বলে মনে হচ্ছে রাতুলের। রাতুলের মা লাইটটা নিভিয়ে দিয়ে বললো ‘পাশের বাড়ির মেয়েটা একটা বই দিয়ে বললো তোকে দিয়ে দিতে। তোর পড়ার টেবিলে রেখে এসেছি।’ রাতুল ধড়ফড় করে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো। মেয়েটা আর কিছু বলেছে কিনা বলবে ভেবেও সাহস হলো না তার। তাড়াতাড়ি ওপরের ঘরে চলে গেলো রাতুল। জানালা খুলে ঘরের আলোটা জ্বালিয়ে দিল। টেবিল থেকে বইটা তুলে নিয়ে মলাট সরিয়ে দেখলো ইতিহাস বই। পাতা ওলটাতে ওলটাতে দেখলো হলদিঘাটের যুদ্ধের পাতাটাতে একটুকরো সাদা কাগজ সেলুটেপ দিয়ে আটকে রাখা একটা চিঠি।
প্রিয় রাতুল,
সারাদিন কতবার দেখা করতে চাইলাম। পারিনি। অন্য উপায় না দেখে এই ব্যবস্থা নিয়েছি। শিলিগুড়িতে আমার মাসির অবস্থা খুব খারাপ। ছোট্টছোট্ট ভাই আর বোন আছে। তাদের দেখার কেউ নেই। আমি আর মা এখন থেকে ওখানেই থাকবো। বাবাও কিছুদিনের মধ্যেই ট্রান্সফার নিয়ে ওখানে চলে যাবে। আমি ওখানে থেকেই পড়াশোনা করবো। আমি কাল অনেক রাতে জানতে পেরেছিলাম। ভেবেছিলাম আজ দেখা করে সব বলবো। তা আর হল না। আজ সন্ধ্যে আটটায় ট্রেন। তাই দেখা করতে যেতে না পারলে ক্ষমা করে দিও। আমি তোমার সঙ্গেই আছি। তোমার থেকে দূরে গিয়ে আমি তোমারই থাকবো। আরো ভালো করে পড়াশোনা করবে। জানি তুমি আমাকে খুব ভালোবাসো। আমিও তোমাকে খুব ভালোবাসি। আমি আবার তোমার কাছে ফিরে আসবো। সেদিন এসেই তোমার সাইকেলে উঠবো, ঘুরবো তোমার সাথে। আমার অপেক্ষায় থেকো।
ইতি
তোমার নীলাঞ্জনা।
জানালার গ্রিলে মাথা রেখে কতক্ষণ যে দাঁড়িয়ে ছিল তা রাতুল মনে করতে পারল না| হুঁশ ফিরল চোখের কোনায় জমে থাকা জলবিন্দুগুলো সিন্ধু হয়ে আকাশ ভেঙ্গে পড়ছে সেই শব্দে| জানালা দিয়ে প্রবল বৃষ্টির ঝাপটা এসে রাতুলকে ভিজিয়ে দিল| জানালাটা খোলা রেখেই ড্রয়ারের চাবি খুলে চোখ বন্ধ করে বের করলো ইতিহাস বইটা। রাতুলের জীবনের বিগত কুড়ি বছরের ইতিহাস। বইয়ের পাতায় রাতুল খুঁজে পেলো নীলাঞ্জনাকে। হলুদ হয়ে যাওয়া চিঠিটা স্পর্শ করতেই রাতুলের চোখ বেয়ে প্রবাহমান জলের ধারা ভিজিয়ে দিচ্ছে কুড়ি বছর আগে রাখা শুকনো গোলাপের পাপড়ি গুলোকে।।
©ভিক্টর মল্লিক
মেনুতে যাবার জন্য