অসম্পূর্ণ

আজ মেজাজটা বড্ড বিগড়ে আছে। অফিসে বসের সাথে একচোট হয়ে গেলো, ফেরার পথে হঠাৎ ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। পুরো কাক ভেজা ভিজলাম। ফ্ল্যাটে ঢুকেই দেখলাম যথারীতি ইলেক্ট্রিসিটি নেই। বড্ড বিরক্তিকর। এখন কেমন যেন অল্পতেই খুব বিরক্ত হয়ে যাই। প্রত্যেকের জীবনের একটা transition period থাকে। আমারও তাই হচ্ছে। আগেও তো এসব ছিল। কই এতটা বিরক্ত বোধ তো আগে কখনো করিনি। বৃষ্টির সময় লাইট অফ করে বৃষ্টি দেখতে, আওয়াজ শুনতেই তো বড্ড ভালো লাগতো। বৃষ্টির ছিটে এসে অল্প অল্প ভিজিয়ে দিয়ে যেত সেই আনন্দে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতাম। এমনও হয়েছে আকাশ ভাঙা বৃষ্টি মাথায় করে বাড়ি ফিরেছি। কিন্তু বিরক্ত কখনো হয়নি। সেসব দিনগুলো কোথায় যেন ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে।

হয়তো ও এখান থেকে চলে যাওয়ার পরপরই এরকম হচ্ছে। ভেবেছিলাম আমার কোনো অসুবিধা হবে না। হবার কথাও নয়। তবে যাওয়ার আগে মনের ব্যাকুলতা অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়ে গেলো।অফিসের কাজে তিনবছরের জন্য ব্যাঙ্গালোর যাওয়ার ঠিক পাঁচ দিন আগে সন্ধ্যের সময় কল করে বললো
একটা অনুরোধ করছি। না করতে পারবে না। আমি তো পাঁচদিন পরই চলে যাচ্ছি। দুটো দিন তোমার সঙ্গে সময় কাটাবো। তুমি না করতে পারবে না। চলো কালই বেরোবো। প্লীজ একটা ব্যবস্থা করো। আমি জানি তুমি পারবে। প্লীজ না কোরোনা।কথা গুলো এক নাগাড়ে বলেই দম নিল সম্পূর্না।
সম্পূর্ণার এই এক অভ্যেস। হঠাৎ হঠাৎ আজব আব্দার। আমি জানি তার এই জেদের কাছে আমি অসহায়।
কোথায় যাবি?’
যেখানে তুমি নিয়ে যাবে। Crowded place টা avoid কোরো প্লীজ। বলো কখন কোথায় অপেক্ষা করবো?’
এত তাড়াতাড়ি কিভাবে কি করব? চেষ্টা করে দেখছি।
দেখছি টেকছি নয়। আমি জানি তোমার পক্ষে সম্বভ। তুমি এখনই ব্যবস্থা করো।
ফোনটা রাখবি তো নাকি! কি যে হয় তোর মাঝে মাঝে! একটু পর তোকে কল করছি। রিসিভ করিস।

জানালায় হঠাৎ খটখট করে আওয়াজ হলো। জানালাটা খোলা আছে মনে হচ্ছে, তা থাক। কতগুলো দিন পার হয়ে গেল তার সাথে কথা নেই। ওখানে পৌঁছে একটা খবর দিলো আমি পৌঁছে গেছি, নিজের খেয়াল রেখো। আর একটু মনে করে ফোন করো আমাকে। এখানে আমি খুব একা।তুই কেমন আছিস খুব জানতে ইচ্ছে করছে। খুব জানতে ইচ্ছে করছে আজও কি সেদিনের সেই একাকীত্ববোধ আছে, না কি কাজের চাপে একা হওয়ার সুযোগই হচ্ছে না। বার দশেক আমাকে কল করেছিল। তিন দিন আগের সাইক্লোনের দুর্যোগ নেটওয়ার্কের দফারফা করে ছেড়ে দিয়েছে। বার বার কল ড্রপ হচ্ছে। এক বর্ণও বুঝতে পারলাম না। বৃথা চেষ্টা।

টার সময় কল করে বললাম
কাল সকাল দশটা নাগাদ এয়ারপোর্ট এক নম্বরে দাঁড়াস। এখন বেশি কথা বলতে পারছি না। কাল দেখা হচ্ছে।” কিছু একটা যেন বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই লাইনটা কেটে গেলো। মোটামুটি একটা ব্যবস্থা করে ফেলেছি। এই প্রথম আমরা একটু দূরে কোথাও গিয়ে দুদিনের সময় কাটিয়ে আসবো। দুদিন পরই সে পারি দেবে এক অন্য জগতে। এরপর কবে কিভাবে দেখা হবে জানিনা। নির্জন ও নিস্তব্ধতার মাঝে দুটো দিন চেনা জানা গন্ডির বাইরে প্রকৃতির মধ্যে অতিবাহিত করবো। ভাবতে ভাবতে কখন চোখ দুটো লেগে গেলো।

জুম কার থেকে একটা গাড়ি ভাড়া করে পৌঁছালাম এক নম্বরে। সময় সকাল দশটা। ওইতো সে দাঁড়িয়ে আছে। সামনে গিয়ে বললাম উঠে আয়।এদিক ওদিক তাকিয়ে সম্পূর্না গাড়িতে উঠে বসল সামনের সিটে। গাড়ি চালাতে শুরু করলাম। একবার তার দিকে তাকিয়ে বুঝলাম একটু tensed.
এত চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন?’ বললাম।
না না তেমন কিছু না। বাড়ি থেকে পালিয়ে এলাম। তোমার সাথে থাকবো বলে।
কি বলছিস!! মাথা খারাপ হয়েছে নাকি তোর?’
এখনো সেই বোকাই আছোবলে একমুখ হাসি। এই তো সেই সম্পূর্না যার সম্পূর্ণতা এতক্ষন পর পেলাম।
ভয় দেখালাম একটু! কেমন লাগছে বললে নাতো? তাড়াহুড়ো করে একটু হালকা টাচ আপ করেই বেরিয়ে গেছি।
‘As usual, seat belt mam’
বেলঘড়িয়া এক্সপ্রেস ধরে বালি ব্রিজের কাছে পৌঁছাতেই দাঁড়াও দাঁড়াও, প্লিজ একটু আসতে আসতে চলো।মায়ের দর্শন না পেলেও দূর থেকেই আশীর্বাদ নিল।

কি হয়েছে তোর? upset মনে হচ্ছে? বাড়িতে কিছু প্রবলেম? বেড়িয়েছিস বলে কোনো সমস্যা?’
‘I am fine.
মন দিয়ে গাড়ি চালাও, গাড়ি চালাতে চালাতে বেশি কথা বলতে নেই। No problem.’
গাড়িটাও বোধহয় এটুকু শোনার অপেক্ষাতেই ছিল। গাড়ির accelerator যত নীচে নামতে থাকলো ততই সামনের দিকে এগোতে থাকলো। রাস্তা আজ বেশ ফাঁকা। ডানকুনি ক্রস করে NH6 এ উঠলাম।
তুই তো একা কখনো কোথাও যাসনি। কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করেনি?’
একা কোথায়? তুমি তো আছো।
তাও ঠিক।
আর বেশি কথা না বাড়িয়ে গাড়ির দিকে মনোযোগ দিলাম। আর সে তার হেডফোনের দিকে। একটা গান চালিয়ে দিয়ে লিপ মেলাতে লাগলাম আর গাড়ি ছুটতে লাগলো।

কোলাঘাট এসে পৌঁছালাম। একটা ধাবায় হালকা টিফিন করে আবার উঠে পড়লাম গাড়িতে। অনেকটা পথ বাকি। সম্পূর্না একমনে তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে। রাস্তা গুলো কিভাবে পিছনের দিকে সরে সরে যাচ্ছে আর গাছ পালাগুলো যেনো পিছনের দিকে দৌড়াচ্ছে। অনেক কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। সম্পূর্না আমার থেকে বছর পাঁচেকের ছোট। প্রথম পরিচয় আমার বেকার জীবনের উপার্জন করার প্রথম পথ। প্রথম ছাত্রী। কিছু কিছু সম্পর্ক কখনই শেষ হয়ে যায় না। ধীরে ধীরে সেই সম্পর্ক আজ প্রকৃত বন্ধুত্বের। এই সম্পর্ককে কোনো নাম দিয়ে বেঁধে রাখা ঠিক হবে না। প্রচলিত প্রেম ভালোবাসার ঊর্ধ্বে অন্যরকম সম্পর্কও থাকে। ভীতু ভীতু মেয়েটা আজ জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত। খড়গপুর পার করে সোজা এগিয়ে চলেছি। ওয়ান ওয়ে রাস্তা ছেড়ে এখন টু ওয়ে রাস্তায় উঠলাম। রাস্তার দুপাশে সবুজ গাছ গাছালি বাড়তে লাগলো। তাড়াতাড়ি পৌঁছাতে হবে। গন্তব্যস্থলে পৌঁছানোর আগে কিছু বাজার করতে হবে। যত এগিয়ে চলেছি ততই আধুনিক শহর সভ্যতা ছেড়ে সবুজের মধ্যে প্রবেশ করছি। সবুজে ঘেরা শাল মহুয়ার জঙ্গল.. লোধাশুলি ফরেস্ট। ঝাঁ চকচকে রাস্তা আর দুই পাশে জঙ্গল। গভীর ঘন অরণ্য। একটু ফাঁকা জায়গা দেখে দাঁড়ালাম। গাড়ি দাঁড় করিয়ে নেমে দাঁড়াতেই কেমন যেন গা টা ছমছম করে উঠলো। লোকজন বিহীন প্রান্তরে কোনো অজানা ভয়ের উপস্থিতি জানান দিতে লাগলো। বেশিক্ষন দাঁড়াতে সাহস হল না। উঠে পড়লাম গাড়িতে। চলতে শুরু করলোকিন্তু আসতে ধীর গতিতে। চোখ কখনো স্টিয়ারিং এ আবার কখনো শাল গাছের শীর্ষে। সবে গজিয়ে উঠা কচি কচি সবুজ পাতাগুলো চোখের মধ্যে ঠান্ডা স্রোত বইয়ে দিচ্ছে। কোথাও কিছু পোড়ানোর চিহ্ন রয়ে গেছে। মনে হচ্ছে গাছপালা পোড়ানো হয়েছে। তারপর সভ্য মানবজাতি নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করেছে।

ধীরে ধীরে শাল মহুয়ার জঙ্গল একদিকে ফাঁকা হতে লাগলো। ছোট ছোট ঘর বাড়ি চোখে পড়ছে। জনবসতি বাড়ছে। সামনে নিশ্চয়ই কোনো গ্রাম আছে বলে মনে হচ্ছে। বাজার ঘাট নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। বাজারটা করে নেওয়া যাবে। জঙ্গল আর সেভাবে চোখে পড়ছে না। রাস্তা হঠাৎ অল্প একটু উঁচু হয়ে ওপরের দিকে উঠতে থাকলো। একটু বাঁক নিতেই দেখি সামনেই বেশ চওড়া এক নদী। এই গরমেও জলরাশিতে পরিপূর্ণ। নদীর ওপর concrete সেতু। ব্রিজের একটু আগে রাস্তার ধারে পার্ক করলাম। গাড়ি থেকে নেমে ব্রিজের দিকে এগিয়ে গিয়ে দেখলাম সিধু-কানু-বিরসা সেতু। নাম তার সুবর্ণরেখাবলেই ব্রিজ ধরে একটু হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে গেলো সম্পূর্না। এখন আরও বেশি চওড়া বলে মনে হচ্ছে। নীচে নামার কোনো ব্যবস্থা নেই। এদিকে বেলাও বাড়ছে। তাই দেরি না করে আবার যাত্রা শুরু হলো। রাস্তার দুপাশ ফাঁকা। লোকজনের যাতায়াত দেখে মনে হচ্ছে সামনেই কোনো গ্রাম পাওয়া যাবে। পেয়েও গেলাম। গোপীবল্লভপুর। রাস্তার পাশেই হাট বসেছে। মাছ, মাংস ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় কিছু সামগ্রী কিনে বেরিয়ে পড়লাম। আবার ফেলে আসা জঙ্গল আমাদের সঙ্গ দিচ্ছে। দুই দিকের জঙ্গল ঘন হতে শুরু করেছে। আগের জঙ্গলের এক্সটেনশন কি না লিংক খোঁজার চেষ্টা করছি। লোধাশুলি ফরেস্ট তারপর সুবর্ণরেখা নদী আর নদীর দুই তীরে গ্রাম্য সভ্যতা গড়ে উঠেছে। তারপর আবার ফরেস্ট। হাতিবাড়ি ফরেস্ট। শহর গ্রামের মত ফরেস্ট গুলোও নাম পেয়েছে!

আর কত দূর?’ সম্পূর্না বলে উঠল। আমাদের গন্তব্যস্থল আর কত দূর ঠিক বুঝতে পারছিনা। রাস্তার দুই ধারে স্থানীয় লোকজন চলাফেরা করছে। তাদের দৈনন্দিন কাজকর্ম করছে। কেউ হাট থেকে ফিরছে সাইকেলে বা হেঁটে, কেউ জঙ্গলের শুকনো ঝরা পাতা, গাছের ডাল মাথায় করে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। গাড়ির গতি বেশ কম। অল্প একটু এগিয়ে যেতেই রাস্তার ওপর বড় সাইনবোর্ডে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা WELCOME TO ODISHA. স্থানীয় লোকেদের জিজ্ঞাসা করলাম হাতিবাড়ি ফরেস্ট বাংলোটা কোথায়?’ বর্ডারের একটু আগেই ডানদিকে কাঁচাপাকা রাস্তা জঙ্গলের ভিতর দিয়ে। ইউটার্ন নিয়ে ঢুকে পড়লাম জঙ্গলের ভিতরের ওই রাস্তায়। ঢুকতেই একটু ভয় ভয় করে উঠলো। জঙ্গলের ভিতর প্রবেশ করছি। শুকনো ঝরা পাতার ওপর দিয়ে গাড়ি চলার স্পষ্ট শব্দ শুনতে পাচ্ছি। আরও কিছুটা এগিয়ে পৌঁছালাম গন্তব্যস্থলে। মাঝারি সাইজের তিনটে দোতলা ঘর, সঙ্গে একটা কিচেন। বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। চারপাশে প্রচুর শুকনো ঝরা পাতা। পরিচয় হলো রাখাল বাবুর সাথে। তিনিই সব দেখভাল করেন। কলকাতা থেকেই ওনার সাথে আগেই সব কথাবার্তা হয়ে গিয়েছিল। দুদিন অফিসাররা কেউই থাকবেন না। তাই পাওয়া সম্বভ হয়েছে। দোতলার এক রুমে আমাদের জায়গা হলো। বাজার ঘাট সব রাখাল দার হাতে দিয়ে উঠে এলাম দোতলার রুমে। মাঝারি আকারের ঘর। একটা লোহার ঘাট, সোফা, টিটেবিল, দুটো চেয়ার, এটাচ বাথরুম, দুটো জানালা। ওপরি পাওনা একটা ব্যালকনি। ব্যালকনি তে পা দিতেই মন উৎফুল্ল হয়ে উঠলো। নিচে কাঁটা তারের বেড়া আর পাশ দিয়েই বয়ে চলেছে ফেলা আশা সুবর্ণরেখা। আমাদের সঙ্গ দিতে আরো কাছেই উপস্থিত। এখানে নদীর বিস্তার আগের মত নয়। নদীর দুই ধার ছোটবড় পাথর দিয়ে বাঁধ দেওয়া হয়েছে। নদীর এই পারে জঙ্গলের মধ্যে কিছু মহিলা জীবন নামের ইঞ্জিনকে সচল রাখতে জীবিকার অন্বেষণে ব্যস্ত। ওই পারে নারীপুরুষ ও বাচ্চারা বেশ সাজ সাজ রবে ভিড় জমিয়েছে। কিছুজন বিভিন্ন আকৃতির পাত্রে নদীর জল বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। মনে হলো কোনো উৎসব আছে। ওই পারে গাছপালা প্রায় নেই। মাটিও বেশ পাথুরে ও রুক্ষ। ওদিকটা ঝাড়খণ্ডবলে উঠলো সম্পূর্না।

তিনটে রাজ্যের বাউন্ডারি লাইনে এক জঙ্গলের ভিতর নদীর ধারে আমরা তিনজন। একটু ফ্রেশ হওয়া দরকার। এই সময় দরজায় টোকা, রাখাল দা দাদাবাবু, এখন চা কফি কিছু খাবেন?’
না না। খাবার জল দিয়ে যেও। তোমার রান্না বান্না কতদূর?’
সবই হয়ে এসেছে.. ভাত, ডাল, আলুভাজা, সবজি আর টক। শুধু একটু মাঝের ঝাল করে দিই। তাহলেই এবেলায় হয়ে যাবে।
বাঃ চমৎকার! দারুণ মেনু। থ্যাংকু রাখাল দা।
রাতে কি খাবেন দাদাবাবু?’
রুটি আর চিকেন।
আর কিছু দরকার হলে ডাক দিবেন।বলে রাখাল দা চলে গেল। ছিমছাম নিপাট ভদ্র মানুষ। প্রথম পরিচয় বলে মনেই হলো না, যেন কতদিনের চেনা জানা। সম্পূর্না ফ্রেশ হতে গিয়েছে। আমি নিচে নেমে বাইরে বেরিয়ে নদীর ধারে এসে দাঁড়ালাম। গাছের ছায়ায় শরীর মন যেন জুড়িয়ে আসছে। কাঁটাতারের অল্প একটু জায়গা ফাঁকা মত আছে। একজন যাতায়াত করার পক্ষে যথেষ্ট। সেখান দিয়ে একবারে নদীর ধারের বাঁধ দেওয়া পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে আছি। পরিষ্কার স্বচ্ছ জল। চমকে উঠলাম শুকনো পাতার খসখস শব্দে।
কি হলো ভয় পেলে নাকি?’ বলে সম্পূর্না এগিয়ে এসে দাঁড়ালো কাঁটাতারের সামনে। খুব সুন্দর জায়গাটা। যাও যাও ফ্রেশ হয়ে নাও।
হ্যাঁ চল।
তুমি যাও, আমি এখুনি আসছি।

স্নান পর্ব সেরে জানালা গুলো খুলে দিলাম। এই দুপুর তিনটেতেও দাবদাহের বিন্দুমাত্র ভাব নেই। রাখাল দা কে ডাকবো ভাবছি এমন সময় সম্পূর্না ও রাখাল দা এসে হাজির।
ও রাখাল দা তোমার হলো! খুব খিদে পেয়ে গেছে গো।
দিদিমণি বাইরে ছিল, ডেকে নিয়ে এলাম। সাপ টাপ আছে তো। শুকনো পাতার ভিতর দেখাও যায় না। আচমকা পা পড়ে গেলে তখন মুশকিল হবে। ওদিকটায় না যাওয়াই ভালো।
একদম ঠিক বলেছেন আপনিসম্পূর্না বললো। আমার রান্না বান্না শেষ। আসুন খেয়ে নিনবলে রাখাল দা এগিয়ে গেলো। আমরা তাকে অনুসরণ করে একটা ডাইনিং রুমে গিয়ে বসলাম। টেবিলে খাওদাওয়ার ব্যবস্থা। খিদেটা বেশ ভালোই পেয়েছিল। খুব তৃপ্তি করে খেলাম। রাখাল দার আতিথেয়তার তার কোনো তুলনাই হয় না। যেমন তৃপ্তির খাওয়া তেমনই তৃপ্তির ঘুম।

ঘুম ভাঙল রাত আট টায়। বড্ড দেরি হয়ে গেল উঠতে। বিকেল সন্ধ্যেটা ঘুমিয়েই কাটিয়ে ফেললাম। কেমন যেন আচ্ছন্ন একটা ভাব। একটা হালকা আলো জ্বলছে। রাখাল দাকে চায়ের কথা বলে এসে দেখি ঘুম ঘুম চোখে বিছানায় সম্পূর্না বসে আছে। একটা টিউব লাইট জ্বালিয়ে দিলাম। একটু পরেই রাখাল দা চা নিয়ে এসে বললো দাদাবাবু নটার মধ্যে রাতের খাবার খেয়ে নেবেন, পাওয়ার কাট করতে হবে।চা টা নিয়ে ব্যালকনি তে চলে গেলাম। চারিদিকে অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা। নিঃস্বাস প্রশ্বাসের শব্দও যেনো শুনতে পাচ্ছি। নদীর দিকে চোখ চলে গেলো। অন্ধকারে চোখে কিছুই পড়ছে না। রুমের আলোটা বন্ধ করে সম্পূর্না পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
ভাবলাম ক্লান্ত আছিস তাই আর ডাকিনি।
সোফায় তোমার ঘুম হলো?’
খুব হলো।
কত নিরিবিলি বলো জায়গাটা!
তোর ভালো লাগছে?’
খুব ভালো লাগছে।
দুজনেই চা শেষ করে বসে আছি ব্যালকনিতে।
আজ যদি আকাশে চাঁদ উঠতো কত ভাল হত বলো।
তোর আশা পূরণ হবে বলে মনে হচ্ছে। মেঘের আড়াল সরে গেলেই চাঁদ দেখতে পাবি। চুপ চুপ..ফিশফিশ করে বললাম কিছু শুনতে পাচ্ছিস?’
দুজনেই চুপ চাপ বসে আছি। হটাৎ শুকনো ঝরা পাতায় খসখস আওয়াজ শুনতে পেলাম। কিছু একটা যেন পাতার ওপর দিয়ে সরে সরে যাচ্ছে। সঙ্গে টর্চ আছে কিন্তু বের করতে ইচ্ছে করছে না। আওয়াজ টা যেন মিলিয়ে গেল। অতিথিদের স্বাগত জানানোর ভঙ্গি নাকি নিজেদের অসন্তুষ্টির বহিঃপ্রকাশ তা বুঝে উঠতে পারলাম না। প্রকৃতি খুবই রহস্যময়। যা উন্মোচন না হওয়াই ভালো। তিনজন ছাড়াও অন্য কোনো প্রাণীর অস্তিত্ত্ব উপলব্ধি করলাম। চারিদিক জোনাকিরা মিটমিট করছে। এক গা ছমছম করা পরিবেশ। আবছা আলোয় নদীটা যেন আরও কাছে এগিয়ে এসেছে। হঠাৎ দরজায় টোকা।

রাখাল দা বলল খাবার তৈরি হয়ে গেছে। নীচে যেতে হবে না। ওপরে দিয়ে যাই।
কি হয়েছে?’
আপনারা আওয়াজ পাননি? কি ঠিক ঠাওর করতে পারিনি। একটু অপেক্ষা করুন আসছিবলে রাখাল দা চলে গেল। সম্পূর্না এখনো ব্যালকনিতে। ওকে এসব কথা না বলাই ভালো। ও ভয় পেলে খুব মুশকিল হবে। সঙ্গে ভীতু মানুষ থাকলে নিজের সাহসের ওপর জিজ্ঞাসা চিহ্ন বসে যায়।
রাখাল দা খাবার এনে টেবিলের ওপর রেখে দিল। জানালা দরজা ভালো করে বন্ধ করে দিন। অসুবিধা হলে ডাকবেনবলেই চলে গেল। বুঝলাম রাখাল দার তাড়াতাড়ি ঘুমানোর অভ্যেস। না ঘুমিয়ে করবেই বা কি। লোকজন হীন এই প্রান্তরে। দরজা জানালা ভালো করে বন্ধ করে দিলাম। তাড়াতাড়ি খেয়ে নাওবলতে বলতে সম্পূর্না ঘরে ঢুকলো। পাওয়ার কাটের কথা মনে পড়ায় দুজনেই খেয়ে নিলাম। দুটো টর্চ দুজনের হাতের নাগালে রেখে দিলাম। সোফায় একটু আরাম করে বসতেই দীর্ঘ পথ যাত্রার ক্লান্তি আবার ঘুমের মধ্যে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। টর্চের তীব্র আলো মুখে পড়তেই আবার জেগে উঠলাম। ঘুমিয়ে পড়েছিলে বুঝি!স্মিত হাসিমুখে সম্পূর্না বলে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গেই পাওয়ার কাট। বন্যপ্রাণীদের রাত্রির নীরবতা যাতে ভঙ্গ না হয় তাই এই ব্যবস্থা।

চারিদিক আবার অন্ধকারে ডুবে গেল। একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখলাম। স্নিগ্ধ আলোয় সম্পূর্না কে চমৎকার দেখাচ্ছে। ক্লান্ত আর ঘুম ঘুম চোখ। চল গিয়ে একটু ব্যালকনিতে বসি।
চলোবলেই লাফ দিয়ে খাট থেকে নেমে এল সম্পূর্না। প্রকৃতির রহস্য অপরিসীম। একটু আগেই ছিল ঘুটঘুটে অন্ধকার। আর এখন আকাশের বুকে হলুদ চাঁদ ধীরে ধীরে সাদা হচ্ছে। ঝকঝকে তারায় আকাশ ভরে উঠেছে। জোৎস্নার আলোয় গাছপালা গুলো যেন স্নান করে নিচ্ছে। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে স্নানের আলো গড়িয়ে পড়ছে। নদীর জলে চাঁদের আলো প্রতিফলিত হয়ে রুপালি প্রভা তৈরি করে চকচক করছে। চারিদিকে ঝি ঝি পোকারা ডাকছে। এক অদ্ভুত গা ছমছমে নীরবতা ও নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে চারপাশে। সেই নীরবতা ভঙ্গ করে হঠাৎ কেমন একটা মায়াবিনী কণ্ঠে সুপর্ণা বলে উঠল আমার সাথে চলো?’
কোথায় যাবো?’
আমি যেখানে যাচ্ছি।
তা হয়না। কখনই সম্বভ নয়।
তুমি সারাজীবন একা একা থাকবে সেটা সম্বভ?’
আমি পারবো। অভ্যেস হয়ে গেছে।
তোমাকে যে জোর করবো সে অধিকার কোনোদিনও তুমি আমাকে দাও নি। আমি কখনো তোমাকে জোর করিনি বলেই তুমি হয়তো আজও আমার সাথে কথা বলো। এতদিন তোমার কাছে না থাকলেও একই শহরে তো ছিলাম, তাই নিশ্চিন্তে ছিলাম। কিন্তু ইচ্ছে না থাকলেও আমি তো অনেকটা দূরে চলে যাচ্ছি। তোমার সাথে এই জায়গায় এসে নিজের অস্তিত্বকে অনুভব করতে পারছি। নিজেকে আগে কখনও এই ভাবে বোঝার সময় হয়ে উঠেনি। ভাগ্গিস তোমার সাথে এই সময়টা অতিবাহিত করতে পারলাম। তোমার থেকে দূরে থাকার ও নিজের একাকীত্ব এখন থেকেই অনুভব করতে পারছি। তুমি ভালোভাবে থাকবে। নিজের খেয়াল রেখো। যাওয়ার দিন দেখা করতে চাইনা। আমিও তোমার মত একা হয়ে যাচ্ছি। তুমি বসো। আমি একটু একাকী থাকতে চাই। থ্যাংকয়ু।
আমার কাঁধে ভরসার একটা হাতের স্পর্শ আর দুফোটা চোখের জল রেখে ভিতরে চলে গেল সম্পূর্না। মোমবাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়েছে বোধহয়।

প্রকৃতি যেন মানুষের মনের ভাষা বুঝতে পারছে। মেঘের আড়ালে চাঁদকে ঢেকে দিয়ে অন্ধকারকে আরোও গাঢ় করে দিয়ে দুটো মানুষকে উপলদ্ধি করার সুযোগ দিয়ে যাচ্ছে। আমি বুঝতে পারলাম সম্পূর্ণা হঠাৎ কেন আমাকে নিয়ে দুটো দিন বাইরে কাটাতে চেয়েছে। সে চায় আমি তার সাথে গিয়ে ভালো থাকি। অনেকবার বলেও বোঝাতে পারিনি আমি খুব ভাল আছি। ও কি ঘুমিয়ে পড়েছে! একবার কি ডাকবো! না থাক। একাকীত্ব অনুভব করতে শিখুক। অল্প অল্প হওয়া দিচ্ছে। গাঢ় অন্ধকারে ঝি ঝি গুলোর ডাক যেন বেড়ে গেলো। নদীটা আর চোখে পড়ছে না। চারিদিকের নিস্তব্ধতা আরও বহুগুণ বেড়ে গেল। আরও স্পষ্ট শুনতে পেলাম শুকনো পাতায় খসখস শব্দ। বেশ বড়সড় কিছু একটা যেন সরে সরে যাচ্ছে। আওয়াজ টা আরও জোরালো হচ্ছে। চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লাম। শব্দটা ক্রমশ কাছে এগিয়ে আসছে। মেরুদন্ড দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত ওপর থেকে নিচে ধীরে ধীরে বইতে শুরু করেছে। গা টা ছমছম করে উঠলো। এমন সময় মনে হল কাঁধের দুপাশ দিয়ে দুটো নরম হাত যেন আমার শরীর বেয়ে নীচে নামছে। আর কানের কাছে ফিসফিস দুটো শব্দ চলে যাচ্ছি।শুকনো পাতার খসখস আওয়াজ টা যেন আমার পায়ের কাছেই হচ্ছে। আর থাকতে না পেরে ঘরে ঢুকে ডাকলাম সম্পূর্না.. সম্পূর্না..। কিন্তু কোনো উত্তর নেই। খসখস শব্দটা ঘরের ভিতরে আমার পায়ের তলায়। ভয়ে উঠে পড়লাম খাটে। স্পর্শ করার চেষ্টা করলাম সম্পূর্ণাকে। কোথায় সম্পূর্না! কেউ তো নেই। মোমবাতি জ্বালালাম। খাটের উপর পড়ে আছে একটা সাদা ওড়না। জানালাটা খোলা। দমকা হওয়ায় বাতিটা নিভে গেল। সম্পূর্না কোথায় গেল! এবার যেন খসখস শব্দটা আমার শরীর বেয়ে উঠছে। ঘরের মধ্যে আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলাম। কিন্তু কোনো আওয়াজ বের হলো না। কলিং বেলের আওয়াজ শুনে ধড়ফর করে উঠে বসলাম। ঘড়িতে সময় সকাল দশটা!!
©
ভিক্টর মল্লিক

মেনুতে যাবার জন্য

About Victor

Discovering my self...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *