তরলের চাপ ও ঘাত (Pressure & Thrust of Fluid)

যে পদার্থ প্রবাহিত হয় বা হতে পারে তাকে প্রবাহী (Fluid) বলে । তরল ও গ্যাস হল প্রবাহী । তরলের নির্দিষ্ট আয়তন আছে কিন্তু কোন আকার নেই । তরল সবসময় পাত্রের আকার ধারণ করে । গ্যাসের নির্দিষ্ট আকার বা আয়তন কোনটাই নেই । যে আয়তনের পাত্রে রাখা হোক না কেন, গ্যাস সেই পাত্রের মধ্যে পুরো জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে । তরল ও গ্যাসের ধর্মে একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য আছে।  গ্যাসকে সহজেই সংনমিত (compress) করা যায় । কিন্তু তরল অসংনম্য (incompressible) ।

ঘনত্ব (Density):

প্রায়ই দেখা যায় যে, কোন পদার্থের একটি ছোট টুকরো অন্য পদার্থের অপেক্ষাকৃত বড় টুকরোর চেয়ে বেশি ভারী । ঘনত্বের ধারণা থেকে এর ব্যাখ্যা পাওয়া যায় । ভারী পদার্থের ঘনত্ব বেশি এবং হালকা পদার্থের ঘনত্ব কম ।

কোন পদার্থের একক আয়তনের ভরকে ওর ঘনত্ব বলে

ঘনত্ব = ভর /  আয়তন

ρ  =  M / V

ঘনত্বের একক:

CGS পদ্ধতিতে ভরের ও আয়তনের একক যথাক্রমে গ্রাম (gm) ও কিউবিক সেন্টিমিটার (cm3 বা cc) ।

SI পদ্ধতিতে ভরের ও আয়তনের একক যথাক্রমে কিলোগ্রাম (kg) ও কিউবিক মিটার (m3) ।

CGS পদ্ধতিতে ঘনত্বের একক gm/cc

SI পদ্ধতিতে ঘনত্বের একক kg/m3

ঘনত্বের মাত্রা হল ML-3

খুব বেশি চাপ প্রয়োগ করলেও কঠিন বা তরলের আয়তন খুব সামান্য কমে । তাই কঠিন বা তরলের ক্ষেত্রে ঘনত্বের উপর চাপের প্রভাব নগন্য বলে চাপের উল্লেখ না করলেও চলে । কিন্তু গ্যাসের ক্ষেত্রে চাপ প্রয়োগ করলে খুব সহজেই সংনমিত হয় । তাই গ্যাসের ক্ষেত্রে উষ্ণতা ও চাপের উল্লেখ করতে হয় ।

আপেক্ষিক গুরুত্ব (Specific gravity):

দুটি পদার্থের ঘনত্বের তুলনা ভাগ করে পাওয়া যায়। কিন্তু বহু পদার্থ নিয়ে এই ধরনের তুলনা করতে হলে একটি বিশাল তালিকা তৈরি হবে । এই অসুবিধা দূর করার জন্য কোন পদার্থের ঘনত্বকে প্রমাণ ধরে এর সঙ্গে অন্য সব পদার্থের ঘনত্বের তুলনা করা হয় । এইভাবেই আপেক্ষিক গুরুত্বের ধারণার উদ্ভব হয় । কঠিন তরলের ক্ষেত্রে 4°C উষ্ণতায় জলের ঘনত্বকে প্রমাণ ধরা হয় । এই উষ্ণতায় জলের ঘনত্ব সর্বাধিক ।

কোন কঠিন বা তরলের আপেক্ষিক গুরুত্ব বলতে ওই পদার্থের ঘনত্ব এবং 4°C উষ্ণতায় বিশুদ্ধ জলের ঘনত্বের অনুপাত বোঝায় বিকল্প সংজ্ঞা হিসেবে বলা যেতে পারে যে, কঠিন বা তরলের আপেক্ষিক গুরুত্ব বলতে ওই বস্তু নির্দিষ্ট আয়তনের ওজন এবং 4°C উষ্ণতায় সম আয়তন বিশুদ্ধ জলের ওজনের অনুপাত

কোন পদার্থের আপেক্ষিক গুরুত্ব = পদার্থের ঘনত্ব ÷ 4°C উষ্ণতায় জলের ঘনত্ব = একক আয়তন পদার্থের ভর ÷  4°C উষ্ণতায় একক আয়তন জলের ভর = যেকোনো আয়তনের পদার্থের ভর ÷ 4°C উষ্ণতায় সময়তন জলের ভর

নির্দিষ্ট স্থানে বস্তুর ভর ওজনের সমানুপাতিক বলে আমরা বলতে পারি, আপেক্ষিক গুরুত্ব = যেকোনো আয়তনের পদার্থের ওজন ÷ 4°C উষ্ণতায় সময়তন জলের ওজন

আপেক্ষিক গুরুত্ব দুটি সমজাতীয় রাশির (ঘনত্ব) অনুপাত হওয়ায় এটি একটি সংখ্যা মাত্র । এর কোন একক নেই । অনেক সময় আপেক্ষিক গুরুত্বকে আপেক্ষিক ঘনত্ব বলা হয় ।

ঘনত্ব আপেক্ষিক গুরুত্বের মধ্যে পার্থক্য:

                         ঘনত্ব

                   আপেক্ষিক গুরুত্ব

1. পদার্থের ঘনত্ব বলতে
একক আয়তনের ভর বোঝায় ।

1. কোনো কঠিন বা তরলের
আপেক্ষিক গুরুত্ব বলতে ওই পদার্থের ঘনত্ব এবং
4°C উষ্ণতায় জলের ঘনত্বের আনুপাত বোঝায় ।

2. ঘনত্বের নির্দিষ্ট একক
আছে ।

2. আপেক্ষিক গুরুত্বের কোন একক নেই ।

3. ঘনত্বের মাত্রা হল ML-3  
 

3. আপেক্ষিক গুরুত্ব মাত্রাহীন

4. CGS পদ্ধতিতে ঘনত্ব
ও আপেক্ষিক
গুরুত্বের মান সমান । কিন্তু অন্যান্য পদ্ধতিতে
এই দুটি মান সমান হয় না ।

4. পরিমাপের সব পদ্ধতিতে
আপেক্ষিক
গুরুত্বের
মান একই হয় ।

প্রবাহীর চাপ এবং ঘাত (Pressure and Thrust of fluid):

আমরা বর্ষাকালে প্রায়ই নদী বাঁধ ভেঙে বন্যা হওয়ার খবর শুনতে পাই । নদীর বাঁধ ভেঙে যাওয়ার কারণ হল জল কর্তৃক বাঁধের একপাশে প্রযুক্ত বল । সুতরাং, এই ঘটনা থেকে বলা যায় জল চাপ এবং বল প্রয়োগ করে । কেবল জলই নয়, সমস্ত তরল এবং গ্যাস অর্থাৎ সমস্ত প্রবাহীরই চাপ আছে ।

ঘাত (Thrust): কোন তরলের উপর কোন প্রবাহী সমস্ত দিক দিকেই বল প্রয়োগ করতে পারে । যখন প্রবাহী তলের উপর লম্বভাবে বল প্রয়োগ করে তখন প্রবাহী কর্তৃক তলের উপর প্রযুক্ত অভিলম্ব বলকেই বলা হয় ঘাত

অর্থাৎ প্রবাহীর সংস্পর্শে অবস্থিত যে কোন তলের উপর প্রবাহী কর্তৃক প্রযুক্ত লম্ব বলকে ঘাত বলে । ঘাত বলতে আমরা বলকেই বুঝি ।

ঘাতের একক: ঘাত একরকম বলকেই বোঝায়, তাই ঘাত ও বলের একক অভিন্ন ।

CGS ও SI পদ্ধতিতে ঘাতের একক যথাক্রমে ডাইন (dyne) ও নিউটন (Newton)।

চাপের সংজ্ঞা : কোন বিন্দুতে প্রবাহের চাপ বলতে ওই বিন্দুর চারিদিকে একটি একক ক্ষেত্রফল কল্পনা করলে ওই ক্ষেত্রফলের উপর প্রবাহী কর্তৃক লম্বভাবে প্রযুক্ত বলকে বোঝায়

প্রবাহীর মধ্যে কোন বিন্দুর চারিদিকে A ক্ষেত্রফল কল্পনা করলে যদি ওই ক্ষেত্রের উপর প্রবাহী কর্তৃক প্রযুক্ত লম্ব বল F হয়, তবে ওই বিন্দুতে চাপ P হবে

চাপ = বল ÷ ক্ষেত্রফল

P = F / A

চাপের একক : CGS পদ্ধতিতে চাপের একক ডাইন/সেমি2 (dyne/cm2) । SI দিতে চাপের একক নিউটন/মিটার2 (N/m2) বা পাস্কাল (Pa)

1 Pa = 1 N/m2 = 10 dyne/cm2

চাপের মাত্রা হল ML-1T-2

ঘাত চাপের মধ্যে সম্পর্ক: কোন তলের উপর প্রযুক্ত ঘাত হল তলের উপর প্রযুক্ত চাপ x তরলের ক্ষেত্রফল।

অর্থাৎ, ঘাত = চাপ x ক্ষেত্রফল

F = P x A

তরলের মধ্যে কোন বিন্দুতে চাপের মান (Pressure of fluid at a point):

মনে করি একটি পাত্রে  ρ ঘনত্বের কিছুটা তরল আছে । তরলের উপরিতল থেকে h গভীরতায় অবস্থিত O বিন্দুতে তরলের চাপ নির্ণয় করতে হবে ।

O  বিন্দু কে কেন্দ্র করে A ক্ষেত্রফল বিশিষ্ট একটি ক্ষুদ্র অনুভূমিক তল কল্পনা করা হল । এখন, A ক্ষেত্রফলবিশিষ্ট এবং h উচ্চতা সম্পন্ন একটি খাড়া তরল স্তম্ভ কল্পনা করা হল । এই তরল স্তম্ভের ওজনই হবে A ক্ষেত্রফলের উপর O বিন্দুতে প্রযুক্ত লম্ব বল বা ঘাত ।

তরল স্তম্ভের ভর = আয়তন x ঘনত্ব = ক্ষেত্রফল x উচ্চতা x ঘনত্ব = Ah x ρ = Ahρ

তরল স্তম্ভের ওজন = তরল স্তম্ভের ভর x অভিকর্ষজ ত্বরণ = Ahρ x g = Ahρg

তরল স্তম্ভের ঘাত (F) = Ahρg

O বিন্দুতে তরলের চাপ = ঘাত ÷ ক্ষেত্রফল

P = F/A = Ahρg/A = h ρ g

তরলের চাপ = গভীরতা x ঘনত্ব x অভিকর্ষজ ত্বরণ

উপরের সমীকরণ থেকে বলতে পারি, প্রবাহীর মধ্যে কোন বিন্দুতে চাপ (i) প্রবাহের উপরিতল থেকে ওই বিন্দুর গভীরতার, (ii) তরলের ঘনত্বের এবং (iii) অভিকর্ষজ ত্বরণের সমানুপাতিক হয় ।

তরলের চাপের বৈশিষ্ট্য:

(i) কোন স্থির তরলের মধ্যে যে-কোনো  বিন্দুতে তরলের চাপ সব দিকে সমান হয় । (ii) কোন স্থির তরলের মধ্যে একই অনুভূমিক তলে সকল বিন্দুতে চাপ সমান । (iii) তরলের মধ্যে কোন বিন্দুতে চাপ তরলের মুক্ত পৃষ্ঠ থেকে ওই বিন্দুর গভীরতার সঙ্গে সমানুপাতিক হারে বৃদ্ধি পায় । (iv) স্থির তরলের মুক্ততল সর্বদা অনুভূমিক থাকে । (v) তরল সমোচ্চশীলতা ধর্ম বজায় রাখে অর্থাৎ পরস্পর নল দ্বারা যুক্ত বিভিন্ন পাত্রে তরলের মুক্ততল একই অনুভূমিক তলে থাকে ।


স্থির তরলের মুক্ততল সর্বদা অনুভূমিক থাকে– 

মনে করো, এই সিদ্ধান্ত অসত্য । একই অনুভূমিক তলে অবস্থিত দুটি বিন্দু A ও B কল্পনা করলে ওদের গভীরতা বিভিন্ন হবে । A ও B বিন্দুর গভীরতা যথাক্রমে h1 ও h2 এবং তরলের ঘনত্ব ρ হলে ওই দুটি বিন্দুতে তরলের চাপ যথাক্রমে h1ρg ও h2ρg হবে । কিন্তু স্থির তরলের মধ্যে একই অনুভূমিক তলে অবস্থিত সকল বিন্দুতে তরলের চাপ সমান । অর্থাৎ A বিন্দুতে তরলের চাপ = B বিন্দুতে তরলের চাপ

h1ρg = h2ρg

h1 = h2

অতএব স্থির তরলের মুক্ততল সব সময় অনুভূমিক থাকে ।

তরলের সমোচ্চশীলতা বলতে কী বোঝায়?

তরলের একই অনুভূমিক তলে থাকা, দুটি বিন্দুতে চাপের পার্থক্য হলে তরল সর্বদা বেশি চাপ যুক্ত অঞ্চল থেকে কম চাপ যুক্ত অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত হয় তাই পরস্পর সংযুক্ত বিভিন্ন পাত্রে জলের উপরিতল অনুভূমিক থাকে সর্বদা একই উচ্চতায় থাকতে চায় তরলের এই ধর্মকে সমোচ্চশীলতা ধর্ম বলে

তরলের সমোচ্চশীলতা ধর্মের একটি প্রাকৃতিক দৃষ্টান্ত হলো আর্টেজীয় কূপ (Artesian well) । পাম্পের সাহায্য ছাড়াই যে কূপ থেকে ভৌমজল স্বতঃস্ফূর্তভাবে কুয়ারার মতো ভূপৃষ্ঠে বেরিয়ে আসে তাকে আর্টেজীয় কূপ বলে ।

সমোচ্চশীলতা ধর্মের ব্যবহারিক প্রয়োগ-

(i) শহরের ঘরে ঘরে জল সরবরাহ ব্যবস্থা । (ii) আর্টেজীয় কূপের সাহায্যে জমিতে জল সেচের ব্যবস্থা ।

শহরে জল সরবরাহ ব্যবস্থা:

জলের সমোচ্চশীলতা ধর্মকে কাজে লাগিয়ে বড় বড় শহরে বাড়ি বাড়ি জল সরবরাহ ব্যবস্থা করা হয় । জল সরবরাহের ধাপ গুলি হল – (i) কাছাকাছি কোন নদী বা জলাশয়ের জল বিভিন্ন পদ্ধতিতে ফিল্টার করে ও জীবাণুমুক্ত করে পাম্পের সাহায্যে একটি উঁচু জলাধারে তোলা হয় । (ii) শহরের সর্বোচ্চ যে স্থানে জল সরবরাহ করতে হয় তার থেকেও বেশি উচ্চতায় জলাধারটি বসানো থাকে । জলাধারের সঙ্গে যুক্ত মুখ্য নল এবং তা থেকে নির্গত বিভিন্ন শাখা নলের মাধ্যমে এই জল শহরের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয় । (iii) মূল নল থেকে শাখা নল গুলিকে বাড়ির কল এবং রাস্তার কলের সঙ্গে যুক্ত করা হয় । কলের প্যাচ খুললে জল তার সমোচ্চশীলতা ধর্মের জন্য জলাধারের সমান উচ্চতায় পৌঁছাতে চায় । ফলে, জল তীব্র বেগে কলের খোলা মুখ থেকে বেরিয়ে আসে । গভীরতার উপরে জলের চাপ নির্ভরশীল বলে, একতলায় যত জোরে জল পড়ে দোতলায় তার থেকে কম এবং তিন তলায় আরও কম জোরে জল পড়বে ।

তরলের গভীরতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে চাপ বৃদ্ধি পায় – পরীক্ষামূলক প্রমাণ:

একটি পাত্রে কোন তরল ধরা যাক জল ভর্তি করা হল । এবার পাত্রটির গায়ে তিনটি ভিন্ন উচ্চতায় একই মাপের তিনটি ছিদ্র করা হল । খেয়াল করলে দেখতে পাবে যে, যে ছিদ্রটি সবচেয়ে বেশি গভীরতায় আছে সেই ছিদ্র দিয়ে জল বেশি দূরে পড়ছে । কম গভীরতায় থাকা ছিদ্র দিয়ে জল অপেক্ষাকৃত কম দূরে পড়ছে । এই পরীক্ষা থেকে সহজে বুঝতে পারি যে তরলের গভীরতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তরলের চাপও বাড়তে থাকে ।

তরলের চাপ ঘনত্বের সাথে পরিবর্তিত হয় – পরীক্ষামূলক প্রমাণ:

ধরা যাক দুটি সমান মাপের পাত্র নিয়ে একটিতে জল ও অন্যটিতে ঘন চিনির দ্রবণ নেওয়া হল । উভয়পাত্রে তরলের উচ্চতা একই রাখা হল । এবার দুটি পাত্রে একই গভীরতায় সমান মাপের দুটি ছিদ্র করা হল । দেখা যাবে যে চিনির দ্রবণ বেশি দূরে গিয়ে পড়ছে । কারণ হলো চিনির দ্রবণের ঘনত্ব সাধারণ জলের ঘনত্বের চেয়ে বেশি । ফলে চিনির দ্রবণ পাত্রের গায়ে বেশি চাপ প্রয়োগ করছে এবং বেশি দূরে গিয়ে পড়ছে । এই পরীক্ষা থেকে আমরা বলতে পারি যে ঘনত্ব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তরলের চাপও বাড়তে থাকে ।

স্থির তরলের মধ্যে একই অনুভূমিক তলে সকল বিন্দুতে চাপ সমান – পরীক্ষামূলক প্রমাণ:

একটি প্লাস্টিকের বোতল নিয়ে সমান উচ্চতায় চারদিকে চারটি ছিদ্র করা হল । এখন বোতলটিতে জল ভর্তি করলে দেখা যাবে যে চারটি ছিদ্র দিয়ে একই বেগে জল বেরিয়ে সমান দূরত্বে গিয়ে পড়ছে । এবং জলের উপরিতলের উচ্চতা উচ্চতা যত কমছে জলের বেগ ও তত কমছে । এই পরীক্ষা থেকে আমরা বলতে পারি যে, স্থির তরলের মধ্যে একই অনুভূমিক তলে সকল বিন্দুতে চাপ সমান হওয়ায় জল চারটি ছিদ্র দিয়ে সমান দূরত্বে গিয়ে পড়ে ।

প্লবতা (Buoyancy):

তরলে বা গ্যাসে আংশিক বা সম্পূর্ণ নিমজ্জিত করলে যে-কোন বস্তুকে অপেক্ষাকৃত হালকা বলে মনে হয় । তরল বা গ্যাস নিমজ্জিত বস্তুর উপর ঊর্ধ্বমুখী ঘাত প্রয়োগ করে । এই ঘাত বস্তুর ওজনের বিপরীত দিকে ক্রিয়া করে । ফলে বস্তুর ওজনের আপাত হ্রাস হয় । বস্তুর ওজন সত্যি সত্যি কমে না; বস্তুর ওজনের একাংশ তরল বা গ্যাস কর্তৃক প্রযুক্ত ঊর্ধ্বঘাত দ্বারা প্রতিমিত হয় মাত্র ।

কোন বস্তুকে স্থির তরল বা গ্যাসীয় পদার্থের আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে নিমজ্জিত করলে ওই তরল বা গ্যাসীয় পদার্থ বস্তুরটির উপর মোট যে পরিমাণ ঊর্ধ্বমুখী ঘাত প্রয়োগ করে তাকে প্লবতা বলে

প্লবতার বৈশিষ্ট্য:

(I) প্লবতা (a) বস্তুর নিমজ্জিত অংশের আয়তন, (b) তরলের ঘনত্ব এবং (c) অভিকর্ষজ ত্বরণের উপর নির্ভর করে ।

(II) প্লবতা সর্বদা বস্তুর ওজনের বিপরীতে ক্রিয়া করে । (III) লোগো তার মান বস্তু দ্বারা অপসারিত তরল বা গ্যাসীয় পদার্থের ওজনের সমান ।

(IV) প্লবতার মান তরলের মধ্যে নিমজ্জিত বস্তুর নিমজ্জননের গভীরতার উপর নির্ভর করে না ।

প্রবাহীর ঘনত্ব বেশি হলে প্লবতার মান বৃদ্ধি পায় কেন?

প্রবাহীর ঘনত্ব বেশি হলে, বস্তুর নিমজ্জিত অংশ দ্বারা অপসারিত প্রবাহির ওজনও বাড়ে । তাই প্রবাহের ঘনত্ব বেশি হলে প্লবতার মান বৃদ্ধি পায় ।

  1. ভারহীন অবস্থায় অর্থাৎ কৃত্রিম উপগ্রহের কোন প্লবতা ক্রিয়া করে না কেন?

নিমজ্জিত বস্তুর আপাত ওজন হ্রাস:

মনে করি কোন বস্তুর ওজন W1 এবং ওর সম আয়তন তরলের ওজন W2 । তরলে পূর্ণ নিমজ্জিত অবস্থায় বস্তুর ওজনের W2 পরিমাণ আপাত হ্রাস হবে । অতএব নিমজ্জিত বস্তুর আপাত ওজন হবে (W1 – W2) ।

নিমজ্জিত বস্তুর আপাত ওজন হ্রাসের উদাহরণ:

(i) কোন ভারী বস্তুকে জলের ভেতর অনায়াসে উপর দিকে তোলা যায় । (ii) জলে নেমে স্নান করার সময় নিজেকে অনেক হালকা মনে হয় । (iii) কুয়ো থেকে বালতি দিয়ে জল তোলার সময় যতক্ষণ বালতি জলের ভিতরে থাকে ততক্ষণ হালকা লাগে ।

আর্কিমিডিসের নীতি (Archimedes’ Principle):

যে-কোন প্রবাহীতে নিমজ্জিত বস্তুর ক্ষেত্রেই প্লবতা নিমজ্জিত বস্তুর ওজনে আপাত হ্রাসের সমান হয় । গ্রিক দার্শনিক আর্কিমিডিস এই নীতি আবিষ্কার করেন । তাঁর নাম অনুসারে, এই নীতিকে আর্কিমিডিসের নীতি বলা হয় ।

কোন বস্তুকে স্থির তরল বা গ্যাসীয় পদার্থে আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে নিমজ্জিত করলে বস্তুটির ওজনের আপাত হ্রাস ঘটে এবং বস্তুর ওজনের এই আপাত হ্রাস বস্তু কর্তৃক অপসারিত তরল বা গ্যাসীয় পদার্থের ওজনের সমান

আর্কিমিডিসের নীতির প্রয়োগ:

(I) যে-কোন আকারের কঠিন বস্তুর আয়তন নির্ণয় করা যায় । (II) বস্তুর ঘনত্ব নির্ণয় করা যায় । (III) কোন সংকর ধাতুর মধ্যে মূল ধাতুগুলির পরিমাণ নির্ণয় করা যায । (IV) কোন বস্তু ফাঁপা বা নিরেট তা নির্ণয় করা যায় ।

  1. আর্কিমিডিসের নীতি কোন কোন ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয় না?

আর্কিমিডিসের নীতি বস্তুর ওজনের ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত । আমরা জানি অবাধে পতনশীল বস্তুর বা বৃত্তাকার কক্ষপথে আবর্তনরত পিতৃম উপগ্রহের ভিতরে বস্তুর কোন ওজন থাকে না । অতএব আর্কিমিডিসের নীতি এসব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয় না ।

 

বস্তুর ভাসন নিমজ্জনের শর্ত (Floation and immersion condiotion of a body):

স্থির তরলে কোন বস্তুকে ফেলা হলে, বস্তুটির উপর মূলত দুটি বল কাজ করে । একটি হল বস্তুর ওজন (W1) যা লম্বভাবে নিচের দিকে ক্রিয়া করে এবং অন্যটি হলো তরলের প্লবতা (W2) যা লম্বভাবে উপরের দিকে ক্রিয়া করে । এই দুটি বলের ক্রিয়ায় তিনটি অবস্থার সৃষ্টি হয় ।

(1) W1 > W2 অর্থাৎ বস্তুর ওজন বস্তু দ্বারা অপসারিত সময়তন তরলের ওজন অপেক্ষা বেশি হলে বস্তুটি তরলের ডুবে যায়

(2) W1 = W2 অর্থাৎ বস্তুর ওজন বস্তু দ্বারা অপসারিত সম আয়তন তরলের ওজনের সমান হলে ওই বস্তু সম্পূর্ণ নিমজ্জিত অবস্থায় তরলের যে কোন স্থানে স্থির থেকে ভাসতে পারে

(3) W1 < W2 অর্থাৎ বস্তুর ওজন বস্তু দ্বারা অপসারিত সময়তন তরলের ওজন অপেক্ষা কম হলে বস্তুর তরলের মধ্যে আংশিক নিমজ্জিত অবস্থায় ভাসে এক্ষেত্রে বস্তু কখনও ডোবে না; সম্পূর্ণ নিমজ্জিত করলে বস্তু আবার ভেসে ওঠে

বস্তুর ভাসন নিমজ্জননের সাথে ঘনত্বের সম্পর্ক:

বস্তুর ঘনত্ব ρ1 ও আয়তন V হলে  বস্তুর ওজন W1= V ρ1g । যদি অপসারিত তরলের ঘনত্ব ρ2 হয় তবে বস্তু দ্বারা অপসারিত সময়তন তরলের ওজন W2= Vρ2g

(1) W1 > W2 হলে ρ1 > ρ2 হয় । অর্থাৎ বস্তুর ঘনত্ব তরলের ঘনত্ব অপেক্ষা বেশি হয়  এবং বস্তুটি ওই তরলের ডুবে যায় ।

(2) W1 = W2 হলে ρ1 = ρ2 হয়।  অর্থাৎ বস্তুর ঘনত্ব তরলের ঘনত্বের সমান হলে বস্তুটির সম্পূর্ণ নিমজ্জিত অবস্থায় তরলের মধ্যে যে কোন স্থানে ভাসে ।

(3) W1 < W2 হলে ρ1 < ρ2 হয় । অর্থাৎ বস্তুর ঘনত্ব তরলের ঘনত্ব অপেক্ষা কম হলে বস্তুর তরলে আংশিক নিমজ্জিত অবস্থায় ভাসে ।

ভাসমান বস্তুর সাম্যের শর্ত (Conditions of equilibrium of a floating body):

ভাসমান বস্তুর উপর দুটি সমান বিপরীতমুখী বল ক্রিয়া করে লম্বভাবে নিচের দিকে বস্তুর ওজন W1 এবং লম্বভাবে উপর দিকে তরলের প্লবতা W2 । প্লবতা বস্তুর নিমজ্জিত অংশ দ্বারা অপসারিত তরলের ওজনের সমান । এই বল দুটি একই সরলরেখা বরাবর ক্রিয়া করলে ভাসমান বস্তুর সাম্যে থাকে । তা না হলে বল দুটি একটি দ্বন্দ্ব গঠন করে এবং এই দ্বন্দ্বের ক্রিয়ায় ভাসমান বস্তুর আবর্ত গতি সৃষ্টি করে । সুতরাং ভাসমান বস্তুকে সামনে থাকার জন্য দুটি শর্তের প্রয়োজন-

(i) ভাসনের শর্ত: ভাসমান বস্তুর ওজন অবশ্যই অপ্রসারিত তরলের ওজনের সমান হবে

(ii) সাম্যের শর্ত: বস্তুর ভারকেন্দ্র এবং প্লবতা কেন্দ্র অর্থাৎ অপসারিত তরলের ভারকেন্দ্র অবশ্যই একই উল্লম্বরেখায় থাকবে

  1. ভাসমান বস্তুর কোন আপাত ওজন নেই কেন?

তরল অপেক্ষা হালকা কঠিন বস্তু ওই তরলে আংশিক নিমজ্জিত অবস্থায় ভাসে । ফলে ভাসমান বস্তুর উপর দুটি সমান ও বিপরীতমুখী বল ক্রিয়া করে – (i) লম্বভাবে নিচের দিকে ক্রিয়ারত বস্তুর ওজন এবং (ii) লম্বভাবে উপরের দিকে ক্রিয়ারত তরলের প্লবতা । প্লবতা অপসারিত তরলের ওজনের সমান । অতএব ভাসমান বস্তুর উপর ক্রিয়া রত মোট বল শূন্য হয় । ফলে ভাসমান বস্তুর কোন আপাত ওজন থাকে না ।

About Victor

Discovering my self...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *