তাপ (Heat):

কিছুক্ষণ রোদে পথ চললে বা আগুনের কাছে দাঁড়ালে আমাদের গরম লাগে । কিন্তু একখণ্ড বরফকে স্পর্শ করলে আমরা ঠান্ডা বোধ করি । যে বাহ্যিক কারণে আমাদের গরম বা ঠান্ডার অনুভুতি জন্মায় তাকে তাপ বলে । সাধারণত কোন বস্তু তাপ গ্রহণ করলে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এবং তা বর্জন করলে শীতল হয়ে পড়ে । কেবলমাত্র অনুভূতির সাহায্যে বা কোন বস্তুর মাধ্যমে আমরা তাপের অস্তিত্ব বুঝতে পারি । সব বস্তুতেই কিছু পরিমাণ তাপ আছে ।

তাপ এক রকমের শক্তি, যা গ্রহণ করে বস্তু উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এবং যা বর্জনে বস্তু শীতল হয় । কোন বস্তু থেকে অন্য বস্তুতে তাপ সঞ্চালনের ফলে যে বস্তু তা গ্রহণ করে তার উষ্ণতা বাড়ে এবং যে বস্তু তা বর্জন করে তার উষ্ণতা কমে । কোন বস্তু করতে গৃহীত বা বর্জিত তাপকেই কেবলমাত্র পরিমাপ করা যায় ।

তাপের একক:

CGS তাপের একক ক্যালরি (Calorie বা Cal)এক গ্রাম বিশুদ্ধ জলের উষ্ণতা এক ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বৃদ্ধি করতে যে তাপের প্রয়োজন হয়, তাকে এক ক্যালরি বলে

SI পদ্ধতিতে তাপের একক জুল (Joule বা J) এক কিলোগ্রাম বিশুদ্ধ জলের উষ্ণতা এক ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বৃদ্ধি করতে যে পরিমাণ তাপের প্রয়োজন হয়,  তাকে এক জুল বলে

1 ক্যালরি = 4.2 জুল

বস্তুর তাপ মাপা হয় ক্যালরিমিটার যন্ত্রের সাহায্যে ।

 

উষ্ণতা বা তাপমাত্রা (Temperature):

উষ্ণতা বা তাপমাত্রা বলতে বস্তুর তাপের তীব্রতা বোঝায় । সহজ ভাষায় কোন বস্তুর উষ্ণতা বলতে বস্তুটি কতটা ঠান্ডা বা গরম তা বোঝায় । দুটি বিভিন্ন তাপমাত্রার বস্তুকে পরস্পরের সংস্পর্শে আনলে বেশি তাপমাত্রার বস্তু থেকে কম তাপমাত্রার বস্তুতে তাপ প্রবাহিত হতে থাকে । উভয় বস্তুর তাপমাত্রা সমান না হওয়া পর্যন্ত এই তাপের আদান-প্রদান চলতে থাকে ।

 

উষ্ণতা হল বস্তুর এমন এক তাপীয় অবস্থা যা তাপ প্রবাহের দিক নির্দেশ করে, অর্থাৎ বস্তুটি অন্য কোন বস্তু থেকে তাপ গ্রহণ করবে অথবা অন্য কোন বস্তুকে তাপ প্রদান করবে তা নির্ধারণ করে

 

উষ্ণতা বা তাপমাত্রার পরিমাপ:

যে যন্ত্রের সাহায্যে উষ্ণতা সঠিকভাবে মাপা যায় তাকে থার্মোমিটার বলে । উষ্ণতা মাপার জন্য বিভিন্ন ধরনের থার্মোমিটারে বিভিন্ন পদার্থ ব্যবহার করা হয় । উষ্ণতার পরিবর্তন হলে ওই পদার্থের কোন একটি ধর্মের মান নিয়মিতভাবে পরিবর্তিত হয়; পরিবর্তন থেকে উষ্ণতা মাপা হয় । উষ্ণতা মাপার জন্য থার্মোমিটারে যে পদার্থের ধর্মের পরিবর্তনকে কাজে লাগানো হয় সেই পদার্থকে উষ্ণতামাপক পদার্থ বলে । পদার্থের যে ধর্মের পরিবর্তনকে কাজে লাগিয়ে উষ্ণতা মাপা হয় সেই ধর্মকে উষ্ণতামাপক ধর্ম বলে ।

আমরা জানি উষ্ণতা বাড়লে অধিকাংশ পদার্থেরই আয়তন বাড়ে । পদার্থের এই আয়তন প্রসারণ উষ্ণতা বৃদ্ধির সমানুপাতিক । সুতরাং আয়তনের পরিবর্তন থেকে উষ্ণতা মাপা সম্ভব । এটিকে কাজে লাগিয়ে পারদ থার্মোমিটার, অ্যালকোহল থার্মোমিটার ইত্যাদি তৈরি করা হয়েছে ।  সুতরাং এসব থার্মোমিটারে পারদ বা অ্যালকোহল হল উষ্ণতামাপক পদার্থ আর আয়তন হল উষ্ণতামাপক ধর্ম ।

উষ্ণতার একক:

CGS পদ্ধতিতে উষ্ণতার একক যথাক্রমে ডিগ্রী সেলসিয়াস (°C) ও ডিগ্রী ফারেনহাইট  (°F)।

SI পদ্ধতিতে উষ্ণতার একক কেলভিন (K)।

তাপ তাপমাত্রার পার্থক্য:

তাপ

তাপমাত্রা

(i) তাপ এক ধরনের শক্তি ।

(i) তাপমাত্রা হলো ঐ শক্তির প্রকাশ । কোন বস্তুর তাপীয় অবস্থাকেই বস্তুটির তাপমাত্রা বলা হয় ।

(ii) তাপকে উষ্ণতার কারণ বলা হয় ।

(ii) তাপমাত্রা হল তাপের ফল ।

(iii) তাপের পরিমাণ এক হওয়া সত্ত্বেও দুটি বস্তুর উষ্ণতা আলাদা হতে পারে ।

(iii) দুটি বস্তুর তাপমাত্রা এক হলেও তাদের তাপের পরিমাণ আলাদা হতে পারে ।

(iv) তাপ মাপা হয় ক্যালরিমিটারের সাহায্যে ।

(iv) তাপমাত্রা মাপা হয় থার্মোমিটারের সাহায্যে ।

(v) দুটি বস্তুর মধ্যে তাপের আদান-প্রদান তাদের তাপের পরিমাণ এর উপর নির্ভর করে না ।

(v) দুটি বস্তুর মধ্যে তাপের আদান-প্রদান বস্তু দুটির তাপমাত্রার পার্থক্যের উপর নির্ভর করে ।

(vi) CGS ও SI পদ্ধতিতে তাপের একক যথাক্রমে ক্যালরি ও জুল ।

(vi) CGS ও SI পদ্ধতিতে তাপমাত্রার একক যথাক্রমে কেলভিন ও ডিগ্রী সেলসিয়াস ।

 

উষ্ণতা মাপার বিভিন্ন স্কেল (Scales of temperature):

থার্মোমিটারের উষ্ণতা মাপার স্কেল তৈরি করার জন্য দুটি নির্দিষ্ট উষ্ণতায় কৈশিক নলের ভিতর পারদ সূত্রের অবস্থান নির্ণয় করা হয় । এই দুটি উষ্ণতাকে থার্মোমিটারের স্থিরাঙ্ক বলে ।

স্থিরাঙ্ক (Fixed point): কোন থার্মোমিটারের স্কেল তৈরি করার জন্য যে দুটি নির্দিষ্ট উষ্ণতা ব্যবহার করা হয় তাদের থার্মোমিটারের স্থিরাঙ্ক বলে

নিম্নস্থিরাঙ্ক (Lower fixed point): প্রমাণ বায়ুমন্ডলীয় চাপে যে উষ্ণতায় বিশুদ্ধ বরফ গলে জল হয় অথবা বিশুদ্ধ জল জমে বরফ হয় সেই উষ্ণতাকে থার্মোমিটারে নিম্নস্থিরাঙ্ক বলে

ঊর্ধ্বস্থিরাঙ্ক (Upper fixed point): প্রমাণ বায়ুমন্ডলীয় চাপে যে উষ্ণতায় বিশুদ্ধ জল বাষ্পে পরিণত হয়, সেই উষ্ণতাকে থার্মোমিটারের ঊর্ধ্বস্থিরাঙ্ক বলে

প্রাথমিক অন্তর (Fundamental interval): থার্মোমিটারের ঊর্ধ্বস্থিরাঙ্ক নিম্নস্থিরাঙ্কের মাঝের উষ্ণতার ব্যবধানকে প্রাথমিক অন্তর বলে

প্রাথমিক অন্তর কতকগুলি সমানভাগে ভাগ করলে উষ্ণতার স্কেল পাওয়া যায় । প্রত্যেক ভাগকে এক ডিগ্রী বলে । স্থিরাঙ্ক দুটির উপরে বা নিচে প্রতি ডিগ্রীর সমান ভাগ এঁকে থার্মোমিটার স্কেলকে আরো বাড়ানো যায় । প্রাথমিক অন্তরকে বিভিন্ন সংখ্যায় ভাগ করলে উষ্ণতার বিভিন্ন স্কেল পাওয়া যায় । সাধারণত থার্মোমিটারে তিন রকম স্কেলের ব্যবহার দেখা যায় । যথা –

(1) সেলসিয়াস বা সেন্টিগ্রেড স্কেল:

সুইডিস বিজ্ঞানী আন্দ্রে সেলসিয়াস এই স্কেল আবিষ্কার করেন। এই স্কেলে নিম্নস্থিরাঙ্ককে 0° সেলসিয়াস এবং ঊর্ধ্ব স্থিরাঙ্ককে 100° সেলসিয়াস ধরা হয় । দুটি স্থিরাঙ্কের মধ্যবর্তী ব্যবধান অর্থাৎ প্রাথমিক অন্তরকে সমান (100 – 0) বা 100 ভাগে ভাগ করা হয় । প্রত্যেক ভাগ এক ডিগ্রী সেলসিয়াস উষ্ণতার পার্থক্য বোঝায় । এই স্কেলে উষ্ণতার পাঠকে ডিগ্রি সেলসিয়াস (degree Celcius বা °C) বলে । অতএব, সেলসিয়াস স্কেলে প্রমাণ চাপে বিশুদ্ধ বরফের গলনাঙ্ক 0°C এবং বিশুদ্ধ জলের স্ফুটনাঙ্ক 100 °C ।

(2) ফারেনহাইট স্কেল:

গাবরিয়েল ড্যানিয়েল ফারেনহাইট এই স্কেলের প্রবর্তক । এই স্কেলে নিম্ন স্থিরাঙ্ক 32° ফারেনহাইট এবং উর্ধ্ব স্থিরাঙ্ক 212° ফারেনহাইট । এই স্কেলে প্রাথমিক অন্তরকে সমান (212 – 32) বা 180 ভাগে ভাগ করা হয় । প্রত্যেক ভাগ এক ডিগ্রী ফারেনহাইট উষ্ণতার পার্থক্য বোঝায় । এই স্কেলে উষ্ণতার পাঠকে ডিগ্রী ফারেনহাইট (degree Fahrenheit বা °F) বলে । অতএব, ফারেনহাইট স্কেলে প্রমাণ চাপে বিশুদ্ধ বরফের গলনাঙ্ক 32°F এবং বিশুদ্ধ জলের স্ফুটনাঙ্ক 100°F।

(3) পরম বা কেলভিন স্কেল:

লর্ড কেলভিন এই স্কেলের প্রবর্তন করেন । এই স্কেলের নিম্ন স্থিরাঙ্ক 273 কেলভিন এবং উর্ধ্ব স্থিরাঙ্ক 373 কেলভিন । প্রাথমিক অন্তরকে সমান (373 – 273) বা 100 ভাগে ভাগ করা হয় । প্রতিটি ভাগ এক কেলভিন উষ্ণতার পার্থক্য বোঝায় । এই স্কেলে উষ্ণতার পাঠকে কেলভিন (Kelvin বা K) বলা হয় । অতএব এইচ স্কেলে প্রমাণ চাপে বিশুদ্ধ বরফের গলনাঙ্ক 273K এবং বিশুদ্ধ জলের স্ফুটনাঙ্ক 373K । আন্তর্জাতিক একক পদ্ধতিতে উষ্ণতার একক কেলভিন এবং কেলভিন এককের ডিগ্রী চিহ্নটি থাকে না ।

স্কেল

নিম্নস্থিরাঙ্ক

ঊর্ধ্বস্থিরাঙ্ক

প্রাথমিক অন্তর

প্রতীক

সেলসিয়াস

0

100

100

°C

ফারেনহাইট

32

212

180

°F

পরম বা কেলভিন

273

373

100

K

উষ্ণতার বিভিন্ন স্কেলের সম্পর্ক:

(1) কেলভিন এবং সেলসিয়াস স্কেলের সম্পর্ক:

কেলভিন এবং সেলসিয়াস এই দুই স্কেলেই প্রাথমিক অন্তর 100 ডিগ্রীর সমান । অতএব,

কেলভিন স্কেলের 100 ঘর = সেলসিয়াস স্কেলের 100 ঘর

∴ কেলভিন স্কেলের 1 ঘর = সেলসিয়াস স্কেলের 1 ঘর

অর্থাৎ, 1K = 1°C

এখন, কোন অজানা উষ্ণতার জন্য কেলভিন স্কেলে পাঠ T K হলে বলা যায় যে, পারদ সূত্র নিম্ন স্থিরাঙ্ক থেকে (T – 273) ঘর পেরিয়েছে, কারণ এই স্কেলে নিম্ন স্থিরাঙ্কের মান 273 । একই উষ্ণতার জন্য সেলসিয়াস কেলে পাঠ t°C পারদ সূত্র t ঘর পেরোয়, এইচকেলে কারণ এই স্কেলে নিম্ন স্থান এর মান 0 । যেহেতু দুটি স্কেলেই এক ঘরের মান সমান, অতএব

T – 273 = t

বা, T K = 273 + t°C

সুতরাং সেলসিয়াস স্কেলে উষ্ণতার পাঠের সঙ্গে 273 যোগ করলে কেলভিন স্কেলে উষ্ণতার পাঠ পাওয়া যায় ।

যেমন 27°C = 273 + 27 = 300 K

(2) সেলসিয়াস ফারেনহাইট স্কেলের সম্পর্ক:

সেলসিয়াস স্কেলে প্রাথমিক অন্তর 100 ঘর এবং ফারেনহাইট স্কেলে প্রাথমিক অন্তর 180 ঘর ।

সেলসিয়াস স্কেলের 100 ঘর = ফারেনহাইট স্কেলের 180 ঘর

∴ সেলসিয়াস স্কেলের 1 ঘর = ফারেনহাইট স্কেলের 180/100 = 9/5 ঘর

বা,  ফারেনহাইট স্কেলের 1 ঘর =  সেলসিয়াস স্কেলের 100/180 =  5/9 ঘর

অর্থাৎ, 1°C = 9/5 °F

বা, 1°F = 5/9 °C

এবার ধরা যাক, সেলসিয়াস ও ফারেনহাইট স্কেলে কোন অজানা উষ্ণতার পাঠ যথাক্রমে C ও F । ফারেনহাইট স্কেলে নিম্ন স্থিরাঙ্কের মান 32; অতএব এই স্কেলে F পাঠের অর্থ পারদ সূত্র নিম্ন স্থিরাঙ্ক থেকে (F – 32) ঘর পেরিয়েছে । একইভাবে সেলসিয়াস স্কেলে C পাঠের অর্থ পারদ সূত্র নিম্ন স্থিরাঙ্ক থেকে (C – 0) বা C ঘর পেরিয়েছে ।

ফারেনহাইট স্কেলের ঘর (F – 32) = সেলসিয়াস স্কেলের C ঘর

∴ ফারেনহাইট স্কেলের 1 ঘর =  সেলসিয়াস স্কেলের C/(F – 32) ঘর

কিন্তু, ফারেনহাইট স্কেলের 1 ঘর =  সেলসিয়াস স্কেলের 5/9 ঘর।

∴ C/(F – 32) = 5/9

বা, C/5 = (F – 32)/9

(3) কেলভিন, সেলসিয়াস ফারেনহাইট স্কেলের সম্পর্ক:

আমরা জানি, C = K – 273 এবং C/5 = (F – 32)/9

C/5 = (F – 32)/9 = (K – 273)/5

 

উষ্ণতামাপক হিসাবে থার্মোমিটারে পারদ ব্যবহারের সুবিধা:

উষ্ণতামাপক পদার্থরূপে অন্যান্য তরল অপেক্ষা পারদ ব্যবহারের অনেকগুলি সুবিধা আছে বলে সাধারনত থার্মোমিটারে পারদ ব্যবহার করা হয় । সুবিধা গুলি হল-

(i) উষ্ণতার পরিবর্তনের সঙ্গে পারদের আয়তন পরিবর্তন খুব নিয়মিত । ফলে থার্মোমিটারে স্কেলের যে কোন জায়গায় সমান সমান ভাগ সমান সমান উষ্ণতা বৃদ্ধির পাঠ দেয় ।

(ii) পরীক্ষা দিন বস্তু থেকে পারদ খুব কম তাপ গ্রহণ করে । ফলে বস্তুর সঠিক উষ্ণতা পাওয়া যায় ।

(iii) তরল বলে পারদের আয়তন প্রসারণ বেশি হয় তাই । এই থার্মোমিটার দিয়ে সূক্ষ্মভাবে উষ্ণতা মাপা যায় ।

(iv) পারদ সহজেই বিশুদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায় ।

(v) পারদের হিমাঙ্ক -39°C ও স্ফুটনাঙ্ক 357°C । সুতরাং এই থার্মোমিটার দিয়ে বিস্তীর্ণ পাল্লার মধ্যে উষ্ণতা মাপা যায় ।

(vi) বিশুদ্ধ পারদ কাচ ভেজায় না । ফলে কৈশিক নলের গায়ে পারদ লেগে থাকে না বলে উষ্ণতা পাঠে ভুল ঘটায় না ।

(vii) অস্বচ্ছ ও চকচকে বলে কাচের ভিতর দিয়ে পারদকে স্পষ্ট দেখা যায় । ফলে উষ্ণতার পাঠ নিতে সুবিধা হয় ।

(viii) তাপের সুপরিবাহী বলে পারদ খুব তাড়াতাড়ি পরীক্ষাধীন বস্তু উষ্ণতায় পৌঁছে যায় ।

 

বস্তুর তাপের পরিমাণ (Quantity of heat):

কোন বস্তু দ্বারা গৃহীত তাপ (i) বস্তুর ভর, (ii) বস্তুর উষ্ণতা বৃদ্ধি এবং (iii) বস্তুর উপাদানের উপর নির্ভর করে

(i) ভরের উপর নির্ভরতা:

 নির্দিষ্ট উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য বস্তু কর্তৃক গৃহীত তাপ বস্তুটির ভরের সমানুপাতিক হয় অর্থাৎ m ভরের কোন বস্তু Q পরিমাণ তাপ গ্রহণ করলে যদি বস্তুটা বস্তুটির উষ্ণতা বৃদ্ধি t হয়, তবে Q m যখন উষ্ণতা বৃদ্ধি বা হ্রাস t নির্দিষ্ট

(ii) উষ্ণতা বৃদ্ধির উপর নির্ভরতা:

নির্দিষ্ট ভরের বস্তু দ্বারা গৃহীত তাপ উষ্ণতা বৃদ্ধির সমানুপাতিক অর্থাৎ নির্দিষ্ট ভরের কোন বস্তু t পরিমাণ তাপ গ্রহণ বা বর্জন করলে যদি বস্তুটির উষ্ণতা বৃদ্ধি বা হ্রাস t হয়, তবে Q t, যখন বস্তুর ভর m নির্দিষ্ট

(iii) বস্তুর উপাদানের উপর নির্ভরতা:

সমান উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য সমান ভরের কিন্তু বিভিন্ন উপাদানের বস্তু করতে গৃহীত তাপ বিভিন্ন হয় অর্থাৎ বস্তু কর্তৃক গৃহীত তাপ বস্তুর উপাদানের উপর নির্ভর করে ।

 

আপেক্ষিক তাপের ধারণা: আমরা সিদ্ধান্ত করতে পারি যে, m ভরের কোন বস্তু Q পরিমাণ তাপ গ্রহণ করলে বস্তুটির উষ্ণতা বৃদ্ধি t হয়,তবে

Q α m , যখন বস্তুর উষ্ণতা বৃদ্ধি t স্থির এবং

Q α t , যখন বস্তুর ভর m স্থির

Q α mt , যখন m ও t উভয়ই  পরিবর্তনশীল

∴ Q = smt

Q = mst

এখানে s একটি সমানুপাতিক ধ্রুবক । যুবকের মান বস্তুর উপাদানের উপর নির্ভর করে । আপেক্ষিক তাপ বলে ।

 

আমরা জানি, Q = mst

এখন m = 1, t = 1 হলে Q = s হবে । অর্থাৎ

একক ভরের কোন পদার্থের উষ্ণতা একক পরিমাণ বৃদ্ধি করতে যে পরিমাণ তাপ প্রয়োজন, তাকে ওই পদার্থের আপেক্ষিক তাপ বলে

আপেক্ষিক তাপের একক:

CGS পদ্ধতিতে আপেক্ষিক তাপের একক ক্যালরি/গ্রাম ডিগ্রী সেলসিয়াস (cal/gm°C) ।

SI পদ্ধতিতে আপেক্ষিক তাপের একক জুল/কেজি কেলভিন (J/kg K) বা জুল/কেজি ডিগ্রী সেলসিয়াস (J/kg°C) ।

 

বিভিন্ন পদার্থের আপেক্ষিক তাপ বিভিন্ন হয় । জলের আপেক্ষিক তাপের মান সবচেয়ে বেশি । সিজিএস পদ্ধতিতে জলের আপেক্ষিক তাপ 1 calorie/gm°C । এসআই পদ্ধতিতে 4200 J/Kg°C ।  কি পদার্থের অবস্থার পরিবর্তনেও আপেক্ষিক তাপের মান পালটে যায় । এমন বরফের আপেক্ষিক তাপ জলের চেয়ে কম । সাধারণত কঠিন পদার্থের আপেক্ষিক তাপের চেয়ে তরলের আপেক্ষিক তাপ বেশি ।

 

সীসার আপেক্ষিক তাপ 0.03 বলতে কী বোঝায়?

সীসার আপেক্ষিক তাপ 0.03 বলতে বোঝায় যে, 1 গ্রাম বিশুদ্ধ সীসার উষ্ণতা 1°C বৃদ্ধি করতে 0.03 ক্যালরি তাপের প্রয়োজন ।

জলের আপেক্ষিক তাপ বেশি হওয়ার সুবিধা:

জলের আপেক্ষিক তাপ (4200 J/Kg°C) অন্যান্য সব কঠিন ও তরল পদার্থের আপেক্ষিক তাপ থেকে বেশি । ফলে নির্দিষ্ট পরিমাণ উষ্ণতা হ্রাসের জন্য জল তুলনামূলকভাবে বেশি পরিমাণ তা বর্জন করে । এজন্য শীতল বস্তুকে উষ্ণ করার জন্য গরম জল ব্যবহৃত হয় । যেমন, সেঁক দেবার বোতলে বা ব্যাগে গরম জল থাকে । শীত প্রধান দেশে ঘরবাড়ি গরম রাখার জন্য পাইপ দিয়ে ঘরে গরম জলের প্রবাহ পাঠানো হয় । আবার নির্দিষ্ট পরিমাণ উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য জল বেশি পরিমাণ তাপ গ্রহণ করে বলে বিভিন্ন ইঞ্জিন ও যন্ত্র শীতলীকরণ করতে জল ব্যবহৃত হয় । বেশি আপেক্ষিক তাপের জন্য জল স্থলভাগ অপেক্ষা ধীরে ধীরে উত্তপ্ত হয়; আবার তাপ ছেড়ে ধীরে ধীরে ঠান্ডা হয় । এই কারণে সমুদ্রের তীরে স্থলবায়ু সমুদ্র বায়ু উৎপন্ন হয় ।

সেঁক দেওয়ার বোতলে গরম জল ব্যবহারের সুবিধা:

জলের আপেক্ষিক তাপ অন্য সব তরলের থেকে বেশি । এজন্য সেঁক দেওয়ার সময় নির্দিষ্ট হারে তাপ বর্জন করলে অন্যান্য তরলের তুলনায় জলের উষ্ণতা হ্রাসের হারও কম হয় । এই কারণে সেঁক দেওয়ার বোতলে অন্যান্য তরলের বদলে গরম জল নিলে অপেক্ষাকৃত বেশি সময় ধরে সেঁক দেওয়া যায় ।

 

বস্তুর উষ্ণতা বৃদ্ধি বা হ্রাসের জন্য গৃহীত বা বর্জিত তাপের পরিমাণ:

কোন পদার্থের আপেক্ষিক তাপ s হলে আপেক্ষিক তাপের সংজ্ঞা থেকে আমরা জানি,

একক ভরের পদার্থের উষ্ণতা 1° বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয়তা তাপ = s একক তাপ

m ভরের পদার্থের উষ্ণতা 1° বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয়তা তাপ = ms একক তাপ

m ভরের পদার্থের উষ্ণতা t° বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয়তা তাপ = mst একক তাপ

উষ্ণতা কমে গেলে বর্জিত তাপের মানও একইভাবে পাওয়া যায় ।

গৃহীত বা বর্ধিত তাপ = বস্তুর ভর x আপেক্ষিক তাপ x উষ্ণতা বৃদ্ধি বা হ্রাস

 

একই ভরের দুটি ভিন্ন বস্তুকে সমান পরিমান তাপ দিলে ওদের উষ্ণতা বৃদ্ধির সমান হয় না কেন?

মনে করি, দুটি বস্তুর ভর m এবং একটি বস্তুর আপেক্ষিক তাপ s1ও অপরটির আপেক্ষিক তাপ s2 । সমান পরিমাণ তাপ Q দিলে প্রথম বস্তুর উষ্ণতা t1° ও দ্বিতীয়টি উষ্ণতা t2° বৃদ্ধি পায় ।

অতএব, প্রথম বস্তু দ্বারা গৃহীত তাপ Q = ms1t1

এবং দ্বিতীয় বস্তু দ্বারা গৃহীত তাপ Q = ms2t2

ms1t1 = ms2t2

s1 / s2 = t1 / t2

যদি s1 > s2 হয় তবে t1 < t2 হবে ।

সুতরাং সমান তা আগ্রহণে সম ঘরের দুটি ভিন্ন বস্তুর উষ্ণতা বৃদ্ধি সমান হয় না; যে বস্তুর আপেক্ষিক তাপ বেশি তার উষ্ণতা বৃদ্ধি অপরটির তুলনায় কম

জলের তুলনায় দুধ তাড়াতাড়ি গরম হয় কেন?

দুধের আপেক্ষিক তাপ জলের আপেক্ষিক তাপের তুলনায় কম । সমভরের জল ও দুধে একই হারে তাপ দিলে দুধের তাপমাত্রা বৃদ্ধি জলের তুলনায় বেশি হবে । এই জন্য দুধ জলের চেয়ে তাড়াতাড়ি গরম হয় ।

তাপগ্রাহিতা (Thermal capacity):

কোন বস্তুর উষ্ণতা 1° বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় তাপকে ওই বস্তুর তাপগ্রহীতা বলে ।

মনে করি, কোন বস্তুর ভর m এবং ওর উপাদানের আপেক্ষিক তাপ s ।

আপেক্ষিক তাপের সংজ্ঞা অনুযায়ী,

একক ভরের বস্তুর উষ্ণতা 1° বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় তাপ = s

m ভরের বস্তুর উষ্ণতা 1° বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় তাপ = m

অতএব, বস্তুর তাপগ্রাহিতা = ms একক ।

কোন বস্তুর তাপগ্রাহিতা = বস্তুর ভর x আপেক্ষিক তাপ

CGS পদ্ধতিতে তাপগ্রাহিতার একক ক্যালরি/°সেন্টিগ্রেড (Cal/°C) ।

SI পদ্ধতিতে তাপগ্রাহিতার একক জুল/কেলভিন (J/K) বা জুল/°সেন্টিগ্রেড (J/°C) ।

জলসম (Water equivalent):

কোন বস্তুর উষ্ণতা 1° বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় তাপ যে পরিমাণ জলের উষ্ণতা 1° বৃদ্ধি করতে পারে, তাকে বস্তুর জলসম বলে

CGS পদ্ধতিতে জলসমের একক গ্রাম (gm) ।

SI পদ্ধতিতে জলসমের একক কিলোগ্রাম (kg) ।

কোন বস্তুর জল সম 50 গ্রাম বলতে বোঝায় যে, বস্তুটির উষ্ণতা 1°C বৃদ্ধি করতে যে তাপ লাগে সেই তাপ দিয়ে 50 গ্রাম জলের উষ্ণতা 1°C বৃদ্ধি করা যাবে

তাপগ্রাহিতা জলসমের তুলনা:

(i) তাপগ্রাহিতা কিছু পরিমাণ তাপ বোঝায় ।

জলসম কিছু পরিমাণ জল বোঝায় ।

(ii) সিজিএস পদ্ধতিতে তাপগ্রহিতা ও জলসমের সংখ্যাগত মান সমান ।

এসআই পদ্ধতিতে তাপগ্রাহিতা ও জলসমের মান এক নয় ।

(iii) তাপগ্রাহীতার একক Cal/°C, J/K, J/°C ।

জলসমের একক gm, kg ।

ক্যালরিমিতির মূলনীতি (Principle of Calorimetry):

দুটি আলাদা তাপমাত্রার বস্তু পরস্পরের সংস্পর্শে তাপের আদান প্রদান করলে বেশি তাপমাত্রার বস্তুটি তাপ বর্জন করবে এবং কম তাপমাত্রার বস্তুটি তাপ গ্রহণ করবে অর্থাৎ উষ্ণ বস্তু কর্তৃক বর্জিত তাপ = শীতল বস্তু করতে গৃহীত তাপ । তাপের এই আদান-প্রদান দুটি বস্তুর তাপমাত্রা সমান না হওয়া পর্যন্ত চলতে থাকবে এটিই হলো ক্যালরিমিতির মূলনীতি

You cannot copy content of this page