বায়ুমণ্ডলের চাপ (Atmospheric Pressure)

পরীক্ষা

একটি দু-মুখ খোলা পাইপ নিয়ে পাইপটির ভিতরে জল ভরে দুদিকের খোলা মুখে আঙুল দিয়ে চেপে লম্বভাবে পাইপটিকে ধরা হল । এখন পাইপের নিচের দিকে আঙুল সরিয়ে নিলে দেখতে পাবে যে পাইপের নিচের মুখটি খোলা থাকা অবস্থাতেও পাইপ থেকে জল পড়ে যাচ্ছে না । এবার পাইপের উপরের মুখ থেকে আঙুল সরিয়ে নিলে দেখতে পাবে যে পাইপের সব জল পড়ে গেল ।

ব্যাখ্যা: এই ঘটনাটির ব্যাখ্যা বায়ুর চাপের সাহায্যে করা যায় । প্রথম অবস্থায় যখন পাইপের উপরের মুখে আঙুল দিয়ে চেপে ধরা হয়েছিল তখন বায়ুর চাপ জলের উপর প্রযুক্ত হয়নি । তাই জল পড়ছিল না । কিন্তু উপরের মুখ থেকে আঙ্গুল সরিয়ে নেওয়ার ফলে বায়ুর চাপ পাইপ এর ভিতরের জলের উপর প্রযুক্ত হয়। তাই জল পাইপের নিচের মুখ দিয়ে পড়ে যায় । এই পরীক্ষা থেকে আমরা বলতে পারি যে বায়ুর চাপ আছে ।

বায়ুমন্ডলের চাপ (Atmospheric pressure):

বায়ুর ওজন থাকায় বায়ুর চাপ দেওয়ার ক্ষমতা আছে ।

কোন বিন্দুর চারিদিকে একক ক্ষেত্রফলের উপর লম্বভাবে বায়ুমণ্ডল তার ওজনের জন্য যে পরিমাণ বল প্রয়োগ করে তাকে বিন্দুতে বায়ুমন্ডলের চাপ বলা হয়

বায়ুমন্ডলের বিভিন্ন জায়গায় চাপের পরিমাণ বিভিন্ন । তাই আমাদের প্রমাণ বায়ুমণ্ডলীয় চাপের ধারণা সম্পর্কে জানতে হবে ।

প্রমাণ বায়ুমন্ডলীয় চাপ: 45° অক্ষাংশে সমুদ্রপৃষ্ঠে 0°C তাপমাত্রায় 76 সেমি উঁচু পারদস্তম্ভ যে চাপ প্রয়োগ করে তাকে প্রমাণ বায়ুমণ্ডলীয় চাপ বলে

প্রমাণ বায়ুমণ্ডলীয় চাপের মান:

প্রমাণ বায়ুমন্ডলীয় চাপ = 76 সেমি উঁচু পারদ স্তম্ভের চাপ = পারদস্তম্ভের উচ্চতা x পারদের ঘনত্ব x অভিকর্ষজ ত্বরণ

= h ρ g

(i) CGS পদ্ধতিতে h = 76 cm, ρ = 13.6 gm/cc

প্রমাণ বায়ুমন্ডলীয় চাপ = 76 x 13.6 x 980 dyne/cm2 = 1.013 x 106 dyne/cm2

(ii) SI পদ্ধতিতে h = 0.76 m,  ρ = 13.6 x 103 kg/m3

প্রমাণ বায়ুমন্ডলীয় চাপ = 0.76 x 13.6 x 103 x 9.81 N/m2 = 1.013 x 105 Pascal

(iii) আবহবিদ্যায় বায়ুমন্ডলের চাপ বার (bar) ও মিলিবার (milibar) এককে প্রকাশ করা হয় ।

1 bar = 105 N/m2

1 milibar = 100 N/m2

প্রমাণ বায়ুমন্ডলীয় চাপ = 1.013 bar = 1013 milibar

(iv) টরিসেলির নাম অনুসারে টর (torr) নামে আরেকটি একক ব্যবহৃত হয় ।

1 torr = 1 mm of Hg এর চাপ = 1334.2 dyne/cm2

প্রমাণ বায়ুমন্ডলীয় চাপ = 760 torr

(v) সাধারণত বায়ুমণ্ডলের চাপ পারুস্তম্ভের উচ্চতা দিয়ে প্রকাশ করা হয় অর্থাৎ এক cm of Hg বা m of Hg ।

 

টরিসেলির পরীক্ষা:

প্রয়োজনীয় দ্রব্য: সমব্যাসযুক্ত এক মিটার লম্বা এক মুখ খোলা একটি কচনল, বিশুদ্ধ পারদ, একটি মিটার স্কেল, বিশুদ্ধ পারদপূর্ণ একটি পাত্র।

পদ্ধতি: (i) সম ব্যাস যুক্ত এক মুখ খোলা এক মিটার লম্বা কাঁচনালটিকে শুষ্ক ও বিশুদ্ধ পারদ দিয়ে পূর্ণ করা হল । লক্ষ্য রাখতে হবে যেন নলের পারদেরর মধ্যে কোন বায়ুর বুদবুদ না থাকে ।

(ii) এবার নলটির খোলা মুখ বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে চেপে ধরে বন্ধ করে বন্ধ অবস্থায় নলটিকে উল্টিয়ে আঙ্গুল সহ নলটির বন্ধ করা মুখটি পারদপূর্ণ পাত্রে পারদের মধ্যে ডুবিয়ে দেওয়া হল ।

(iii) এবার স্ট্যান্ড এর সাহায্যে নলটিকে খাড়া করে রাখা হল ।

পর্যবেক্ষণ: (i) কাচনলের মধ্যে দিয়ে পারদ আস্তে আস্তে নিচে নামতে থাকল । যখন নলের ভিতরের পারদের চাপ ও বাইরের পারদের চাপ সমান হল তখন পারদ স্থির হয়ে থাকল । নলের পারদস্তম্ভের উপরের শূন্যস্থান বায়ুশূন্য । একে টরিসেলির শূন্যস্থান বলে । এখানে পারদ বাষ্প থাকে ।

(ii) নলটি বামদিকে বা ডানদিকে হেলিয়ে দেখা গেল পারস্তম্ভের উচ্চতা একই থাকছে ।

(iii) পারদ পাত্রের পারদতল থেকে নলের পারদস্তম্ভের উচ্চতা প্রায় 76 সেন্টিমিটার ।

ব্যাখ্যা: পারদ পাত্রের পারদের উপর বায়ুমন্ডলের নিম্নমুখী চাপ পারদের মধ্য দিয়ে কাচনলের খোলা মুখের মধ্যে দিয়ে নলের পারদের উপর ঊর্ধ্বমুখী চাপ প্রয়োগ করছে । যখন এই উর্ধমুখী চাপ ও নলের পারদেরর নিম্নমুখী চাপের মান সমান হচ্ছে  তখন নলের পারদস্তম্ভ স্থির থাকছে । বায়ুমণ্ডলীয় চাপ 76 সেমি পারদ স্তম্ভের চাপের সমান হওয়ায় কাচনলে পারদ স্তম্ভের উচ্চতা 76 সেমি হয় সেই অবস্থায় কাচনলে পারদ স্থির অবস্থায় থাকে ।

 

সিদ্ধান্ত: (i) টরিসেলির শূন্যস্থান একেবারে শূন্য নয় । এখানে পারদ বাষ্প থাকে ।

(ii) পারদ পূর্ণ কাচনলটি যেকোন দিকে হেলালে উপরের শূন্যস্থান কমবে কিন্তু পারদ পাত্রের পারদ তল থেকে কাচনলের পারদস্তম্ভের উচ্চতা অপরিবর্তিত থাকবে ।

(iii) বায়ুমন্ডলের চাপ বাড়ালে পারদস্তম্ভের উচ্চতা বাড়বে এবং চাপ কম কমালে পারদস্তম্ভের উচ্চতা কমবে ।

(iv) কাচনলের প্রস্থচ্ছেদের উপর পারদস্তম্ভের উচ্চতা নির্ভর করে ।

(v) কাচনলের বদ্ধ প্রান্তে ছিদ্র করলে নলের পারদ পারদ পাত্রে নেমে যাবে ।

বায়ুর চাপ মাপার যন্ত্র:

যে যন্ত্রের সাহায্যে বায়ুমন্ডলের চাপ পরিমাপ করা হয় তাকে ব্যারোমিটার বলে । টরিসেলির পরীক্ষায় পারদস্তম্ভের মধ্যে উল্টানো অবস্থায় পারদপূর্ণ নলকে একটি সরল ব্যারোমিটার বলা যেতে পারে । কিন্তু এই নীতির উপর ভিত্তি করে একটি উন্নত মানের ব্যারোমিটার নির্মাণ করা হয়েছে । এটির নাম ফর্টিন ব্যারোমিটার ।

ব্যারোমিটারে পারদ ব্যবহারের সুবিধা:

অন্যান্য তরলের পরিবর্তে ব্যারোমিটারে পারদ ব্যবহারের কয়েকটি সুবিধা আছে ।

(I) পারদের ঘনত্ব বেশি হওয়ায় ব্যারোমিটারের নলের উচ্চতা ব্যবহারিক সীমার মধ্যে রাখা যায় । (II) পারদের বাষ্প চাপ নগণ্য হওয়ায় টরিসেলির শূন্যস্থানে অবস্থিত বাষ্পের চাপ ব্যারোমিটারের পাঠকে প্রভাবিত করতে পারে না । (III) পারদ উজ্জ্বল ও চকচকে বলে নলের বাইরের থেকে এর অবস্থান পরিষ্কার বোঝা যায় । (IV) পারদ কাচের গায়ে লেগে থাকে না বলে নলের মধ্যে বিনা বাধায় ওঠানামা করতে পারে । (V) পারদের হিমাঙ্ক -39°C । এজন্য শীত প্রধান দেশে পারদ ব্যারোমিটার ব্যবহার করার সুবিধাজনক । (VI) পারদের স্ফুটনাঙ্ক 357°C । ফলে সাধারণ উষ্ণতায় টরিসেলির শূন্যস্থানে খুব কম পরিমাণ পারদ বাস্প থাকে এবং এর চাপ নগণ্য বলে উপেক্ষা করা যায় । (VII) পারদ তাপের সুপরিবাহী বলে পারদস্তম্ভের সর্বত্র উষ্ণতা সমান থাকে । (VIII) পারদ অস্বচ্ছ ও চকচকে বলে বাইরে থেকে কাচের মধ্য দিয়ে পারদের লেভেল সহজে দেখা যায় ।

ব্যারোমিটারের সাহায্যে আবহাওয়ার পূর্বাভাস কিভাবে পাওয়া যায়:

বায়ুমণ্ডলের সব সময় কিছু না কিছু জলীয় বাষ্প থাকে । শুষ্ক বায়ুর ঘনত্বের তুলনায় জলীয় বাষ্পের ঘনত্ব কম । তাই বায়ুতে জলীয়বাষ্পের পরিমাণ বাড়লে বায়ুর ঘনত্ব কমে যায়; ফলে বায়ুর চাপও কমে ।

(i) কোন স্থানে ব্যারোমিটারে পারদস্তম্ভের উচ্চতা ধীরে ধীরে কমতে থাকলে বোঝা যায় যে বায়ুতে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বাড়ছে অর্থাৎ বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে ।

(ii) পারদ স্তম্ভের উচ্চতা যদি ক্রমশ কমতে থাকে তাহলে বোঝা যায় যে, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার সম্ভাবনা আছে এবং এই ধরনের আবহাওয়া কয়েক দিন ধরে চলতে পারে ।

(iii) কোন স্থানে পারদস্তম্ভের উচ্চতা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকলে বোঝা যায় যে, বায়ুতে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ কমছে অর্থাৎ আবহাওয়া ও শুষ্ক ও পরিষ্কার থাকবে । পাকিস্তানপের উচ্চতা দ্রুত বাড়লে বোঝা যায় যে সাময়িকভাবে আবহাওয়া পরিষ্কার থাকবে।

(iv) কোন স্থানে পারদস্তম্ভেরপ উচ্চতা অর্থাৎ বায়ুমণ্ডলের চাপ যদি হঠাৎ দ্রুত কমে যায় তাহলে ওই স্থানে নিম্নচাপের সৃষ্টি হয় এবং আশেপাশের উচ্চচাপ অঞ্চল থেকে বায়ু দ্রুত বেগে ওই নিম্নচাপ অঞ্চলের দিকে ধাবিত হয়; ফলে ঝড় বা ঘূর্ণিঝড়ের সম্ভাবনা পূর্বাভাস করা যায় ।

অবশ্য যে-কোন স্থানের হওয়া অনেকগুলি বিষয়ের উপর নির্ভর করে । সুতরাং শুধুমাত্র ব্যারোমিটারের সাহায্যে কোন স্থানের আবহাওয়ার অত্যন্ত প্রাথমিক ধরনের পূর্বাভাস করা যায় ।

সাইফন (Siphon):

সাইফন এমন একটি যন্ত্র যার সাহায্যে স্থির অবস্থায় থাকা একটি পাত্রের তরলকে বায়ুমন্ডলের চাপের সাহায্যে অন্য একটি অপেক্ষা কৃত নিচু জায়গায় রাখা পাত্রে স্থানান্তরিত করা যায় ।

বর্ণনা ক্রিয়া: সাইফন হল U আকৃতির অসম দৈর্ঘ্যের বাহুবিশিষ্ট দুমুখ খোলা নল । যে তরলটিকে স্থানান্তরিত করতে হবে প্রথমে সেই তরল দ্বারা নলটি পূর্ণ করা হয় । নলের দুমুখ আঙুল দিয়ে বন্ধ করে ছোট বাহুটিকে তরল পূর্ণ পাত্রে ডোবানো হয় এবং বড় বাহুটি কে খালি পাত্রে রাখা হয় । এবার আঙ্গুল সরিয়ে নিলে সাইফন ক্রিয়া শুরু হবে এবং তরল পূর্ণ পাত্র থেকে তরল নলের মধ্য দিয়ে খালি পাত্রে জমা হতে থাকবে ।

সাইফনের কার্যনীতি:

সাইফনের দুটি বাহুর উপরের অংশে মনের মধ্যে একই অনুভূমির তলে দুটি বিন্দু B ও C বিবেচনা করা হল ।

A ও D বিন্দুতে চাপ বায়ুমণ্ডলের চাপের সমান ।

বায়ুমন্ডলের চাপ = P, পাত্রের তরলতল থেকে বি বিন্দুর উচ্চতা = h1 , বড়বাহুর খোলা মুখ D থেকে C বিন্দুর উচ্চতা = h2 এবং তরলের ঘনত্ব = r

সুতরাং, B বিন্দুতে চাপ = P – h1ρg

এবং C বিন্দুতে চাপ = P – h2ρg

যেহেতু h2 > h1

অতএব, B বিন্দুতে চাপ > C বিন্দুতে চাপ ।

সুতরাং, B থেকে C বিন্দুর দিকে তরল প্রবাহিত হবে । B বিন্দু থেকে তরল প্রবাহিত হয়ে গেলে শূন্যস্থান পূরণের জন্য বায়ুমণ্ডলের চাপে পাত্র থেকে তরল AB নল বেয়ে উপরে উঠবে । এভাবে সাইফোনের মধ্যে দিয়ে অবিরাম তরল প্রবাহ চলবে ।

সাইফনের ক্রিয়া চাপের উপর নির্ভর করে । চাপ বলতে একক ক্ষেত্রফলে প্রযুক্ত বল বোঝায় । অতএব সাইফনের ক্রিয়ার জন্য নলের প্রস্থচ্ছেদ সুষম হওয়ার দরকার হয় না ।

সাইফন ক্রিয়ার শর্ত:

(i) বায়ুশূন্যস্থানে সাইফন ক্রিয়া করে না । কারণ বায়ুমণ্ডলের চাপ না থাকলে পাত্র থেকে সাইফনের বাহুতে তরল উঠবে না । সাইফনের ক্রিয়াও বন্ধ হয়ে যাবে ।

(ii) যে তরল স্থানান্তরিত করতে হবে তা দিয়ে সাইফনকে প্রথমে পূর্ণ করে নিতে হবে ।

(iii) পাত্রের তরলের উপরতল সাইফনের নিমজ্জিত প্রান্ত A-র নীচে না পৌঁছানো পর্যন্ত সাইফন ক্রিয়া করবে ।

(iv) h2 উচ্চতা সবসময় h1 অপেক্ষা বেশি হতে হবে। তা না হলে B বিন্দুতে চাপ কখনও C বিন্দুতে চাপের চেয়ে বেশি হবে না । ফলে সাইফন ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাবে ।

সাইফনের ব্যবহারিক প্রয়োগ: শৌচাগারের স্বয়ংক্রিয় ফ্লাশ (Automatic flushes) সাইফনের নীতিতে কাজ করে । একমাত্র থেকে অপরপাত্রে তরলকে নাড়াচাড়া না করে বা না ঢেলে স্থানান্তরিত করতে সাইফন ব্যবহৃত হয় ।

About Victor

Discovering my self...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *