করমণ্ডল এক্সপ্রেসের ভয়াবহ দুর্ঘটনায় নিহতদের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি এবং আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করি। সকল পরিবার পরিজনদের প্রতি সমবেদনা জানাই।
সবে সবে নিউটাউনের এক কামরার ফ্ল্যাটে গিয়ে উঠেছে বৃষ্টি আর আকাশ। আকাশ প্রায় বছর পাঁচেক আগে এই ফ্ল্যাটটা কিনেছিল। এখানকার খোলামেলা জায়গা ছিমছাম নিস্তব্ধ পরিবেশ এবং সবুজের আধিক্য আকাশের বেশ ভালো লেগেছিল। ফ্ল্যাটটাকে নতুনভাবে সংস্কার করে আকাশ তিন মাস মত হবে এখানে থাকতে শুরু করেছিল। আর বৃষ্টি থাকতো তার বাবার সঙ্গে হৃদয়পুরের বাড়িতে। মাস ছয়েক আগে তারা রেজিষ্ট্রি করেছে। আজ থেকে দুজনে একসাথে থাকতে শুরু করছে। তারা ঠিক করেছিল ফ্ল্যাটে শিফট করার দিনই মন্দিরে গিয়ে সামাজিকভাবে বিয়েটা সেরে একসাথে ফ্ল্যাটে এসে উঠবে। দুজনের কেউই চায়নি ঢাকঢোল পিটিয়ে হৈচৈ করে বিয়ের অনুষ্ঠান করতে। আজকের এই বিশেষ দিনটিতে ওরা দু’জন ছাড়া সঙ্গে আর কেউই নেই।
দু’জনে মিলে আগে থেকেই প্ল্যান করে রেখেছিল। সেই মতো সকাল আটটা থেকে মন্দিরের গেটের সামনে অপেক্ষা করছে আকাশ। আকাশ আজ পরে আছে হলুদ রঙের পাঞ্জাবি আর সাদা রঙের পায়জামা। বারবার তার উৎসুক চোখ চলে যাচ্ছে মন্দিরের গেটের সামনে চওড়া রাস্তার দিকে। তার মনের মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা কাজ করছে। আকাশ এক জায়গায় স্থির ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে পায়চারি করতে লাগল। সময় দেখল হাত ঘড়িটায়। কপালটা কুঁচকে বলল সাড়ে আটটা বেজে গেল কিন্তু এখনও এলো না কেন। আকাশ বিড়বিড় করছে উফফ! কি আক্কেল এই মেয়েটার! কোনো মানে হয়! রোজকার মত আজকের দিনেও দেরি! বৃষ্টি বারবার করে বলে দিয়েছিল আজ সে সময়ের আগেই চলে আসবে। নানা রকম চিন্তা ভাবনা আকাশের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। এতদিনের অভ্যেস কি আর একদিনে চলে যায় মনে মনে বলে আকাশ নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। যত সময় অতিবাহিত হচ্ছে তার মনে হচ্ছে সে যেন অনন্ত কাল ধরে এখানে অপেক্ষা করছে।
ঘড়ির কাঁটা ন’টার দরজায় কড়া নাড়ছে। ঠিক সেই সময় আকাশের চোখ চলে গেল মন্দিরের সামনে দিয়ে ধীরস্থির পদক্ষেপে তার দিকে এগিয়ে আসা এক রমণীর দিকে। পরিমিত সাজে সজ্জিত রমণীর পরনে লাল হলুদ ঢাকাই। ঠোঁটে লিপস্টিকের হালকা ছোঁয়া। কাজল কালো চোখে কাজলের রেখা। কপালে ছোট্ট একটা লাল টিপ। খোপা করা চুলে জুঁই ফুলের মালা। রমণীর দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকা আকাশের মনের ভাব বুঝতে পেরে গাল ভরা হাসিতে বৃষ্টি বললো কি মশাই এমন হা করে তাকিয়ে আছেন যে। কোনোদিন আমাকে দেখেননি বুঝি। আকাশের বিহ্বলতা কাটিয়ে স্বাভাবিক ছন্দে ফিরতে একটু সময় লাগলো। তারপর বৃষ্টির চোখে চোখ রেখে বললো তোমাকে এমন ভাবে কোনোদিনও দেখিনি। তোমাকে আজ খুব সুন্দর লাগছে। বৃষ্টি একটু ভুরু কুঁচকে বললো তাই বুঝি। পাত্রের তবে পাত্রী পছন্দ বলছো তো! তারপর বৃষ্টি আকাশের হাত ধরে বললো চলো। আকাশও শক্ত করে বৃষ্টির হাত ধরে হাসি হাসি মুখে বললো চলো। শুরু হলো আকাশ ও বৃষ্টির একসাথে পথ চলা।
মন্দির থেকে বেরিয়ে একটা রেস্তোরায় বসে খাওয়া দাওয়া সেরে বৃষ্টি ফ্ল্যাটে চলে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু আকাশ বলেছিল চলো না আজ আমরা আমাদের স্মৃতি বিজড়িত জায়গাগুলোতে একটু ঘুরে তারপর ফিরবো। কথাটা বৃষ্টিরও পছন্দ হয়েছিল। ভিক্টোরিয়া হয়ে ময়দান ঘুরে প্রিন্সেপ ঘাট তারপর গঙ্গাবক্ষে নৌকাবিহার করে তাদের ফিরতে বেশ সন্ধ্যে হয়ে গেল। ছোট্ট এক কামরার ফ্ল্যাটটা বৃষ্টি নিজের মনের মত করে সাজিয়েছে। আকাশ বার বার করে বলতো এইটুকু জায়গায় থাকতে তোমার খুব অসুবিধা হবে বলো। আকাশের আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে বৃষ্টি অবগত আছে। আকাশের কাঁধে এখন অনেক লোনের বোঝা। আকাশের কথায় বৃষ্টি প্রতিবারই বলতো তুমি জানো ছোট ঘরে থাকার কত সুবিধা। ঘর যত ছোট হবে তত আমরা কাছাকাছি থাকতে পারবো। চাইলেও তুমি বা আমি দূরে দূরে সরে থাকতে পারবো না। ঝগড়া রাগারাগি হলেও না। বৃষ্টি আকাশকে অনেক করে বুঝিয়েছে এইসব ফালতু চিন্তাকে প্রশ্রয় দেবে না। তবু আকাশের মনের মধ্যে একটা কিন্তু ভাব রয়েই গেছে। আকাশ জানে আপাতত তাকে এখানেই থাকতে হবে। তাই সে এখন এসব চিন্তাকে আর বেশি প্রশ্রয় দিতে চায় না।
ফ্ল্যাটে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিল বৃষ্টি। আকাশ চেয়ারে বসে জুতো জোড়া খুলতে গিয়েও পারলো না। বৃষ্টি পিছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরলো আকাশকে। আদুরে গলায় বলল আই লাভ ইউ আকাশ। আকাশ চেয়ার থেকে উঠে বৃষ্টিকে নিজের বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে বলল বৃষ্টি আমিও তোমাকে খুব ভালোবাসি। আজকের বিশেষ দিনটাতে সারাদিন আকাশের উদাসীনতা বৃষ্টির চোখ এড়িয়ে যায়নি। আকাশের বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে বৃষ্টি তাকিয়ে রইলো আকাশের অশ্রুসিক্ত দুই চোখের দিকে। আকাশের মাথাটা বুকের মাঝে নিয়ে মাথায় হাত বোলাতে লাগলো। আকাশের মনের গভীরে যে মেঘ জমেছে তার খবর একমাত্র বৃষ্টিই জানে। এরকম অবস্থায় বৃষ্টিই পারে তাকে সামলাতে। আকাশের চোখের জল অবিরত নিরবে ভিজিয়ে দিচ্ছে বৃষ্টিকে। বৃষ্টি জড়িয়ে ধরলো আকাশকে। কেউ কোনো কথা বলতে পারছে না। নিস্তব্ধতার আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়ে রইলো ওরা দু’জন। কিছু সময় পর হাত ধরে আকাশকে ব্যালকনিতে নিয়ে এলো বৃষ্টি। ব্যালকনিতে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে দুজনে। রাতের আকাশের দিকে আঙুল তুলে কাছাকাছি দুটো তারা দেখিয়ে বৃষ্টি বললো, দেখো ওই তারা দুটো কতদূর থেকে আমাদের আলোর দিশা দেখাচ্ছে। বাবা মাও এভাবেই সবসময় আমাদের আশীর্বাদ করে যাচ্ছেন। ওনারা সবসময় আছেন আমাদের সঙ্গে। আকাশ আর নিজেকে সামলাতে পারলো না। বৃষ্টির বুকে মাথা দিয়ে অশ্রুজলে সিক্ত করে ফেলল বৃষ্টিকে।
রাত গভীর থেকে গভীরতর। জোৎস্নার আলোয় রাতের আকাশ ভেসে যাচ্ছে। চারিদিকে নিস্তব্ধতার পরিবেশ। আকাশ থেকে চুঁইয়ে পড়া জোৎস্নার আলোর অন্তরালে বৃষ্টির কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে আকাশ। আকাশের মনের গভীরে জমা মেঘের আঁধার সরে গেছে। আকাশ এখন স্বচ্ছ। আকাশ ও বৃষ্টি একে অপরকে আদরে আদরে ভরিয়ে দিয়েছে। বিনিদ্র রজনী যাপন করছে সদ্য বিবাহিত দম্পতি। কারোর চোখে মুখে ঘুমের বিন্দুমাত্র আবেশ নেই। এখন দুজনেই বেশ স্বচ্ছন্দ বোধ করছে। মনের গভীরে জমিয়ে রাখা কতশত স্মৃতি আজ তাদের চোখের সম্মুখে প্রবাহমান। দেখতে পাচ্ছে তাদের দীর্ঘ দিনের সম্পর্কের ইতিকথা। স্মৃতিগুলো যেন আজ চলচ্চিত্র হয়ে দেওয়ালের পর্দায় ভেসে উঠছে। বৃষ্টি ও আকাশের অতীত জীবনের ফেলা আশা স্মৃতি অতলে হারিয়ে যাওয়া পুরানো দিনের সময়গুলো তাদের মনের ক্যানভাসে উদ্ভাসিত। চোখের সম্মুখে জীবন্ত হয়ে উঠেছে সোনালী সেই দিনগুলো। সময়ের উল্টো স্রোতে সময়ের সরণি বেয়ে অতীত জীবনের স্মৃতিচারণ করছে।
ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। পাখিদের কিচিমিচির শব্দ শোনা যাচ্ছে। ভোরের স্বল্প আলোয় ঘুম ভেঙে গেলো আকাশের। একাকীত্বে অভ্যস্ত আকাশ অনুভব করলো তাকে জড়িয়ে শুয়ে আছে বৃষ্টি। বৃষ্টির বন্ধনকে মুক্ত করার কোনো ইচ্ছেই তার হলো না। আকাশ আরও গভীরভাবে জড়িয়ে ধরলো বৃষ্টিকে। ভোর শেষে সকালের নরম আলো জানালা দিয়ে এসে পড়ছে বৃষ্টির মুখে। আকাশ তাকিয়ে আছে বৃষ্টির লাবণ্য মাখা মুখের দিকে। বৃষ্টি হাত বাড়িয়ে আকাশের গলাটা জড়িয়ে ধরে গালে কপালে আদর করে বললো আজ থেকে আর একদম মন কেমন করবে না। আমি এসেছি তোমার কাছে তোমার সাথে থাকতে। আকাশ অল্প হেসে বললো তুমি এভাবেই সারা জীবন পাশে থেকো।
আজ ছুটির দিন। আজকের দিনের জন্য আকাশ ও বৃষ্টি দুজনেই নিজেদের খুব ঘনিষ্ঠ দু’চারজনকে ওদের ফ্ল্যাটে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। সেই নিয়ে ওদের মধ্যে ব্যস্ততা রয়েছে। যদিও হুড়োহুড়ির কোনো স্থান নেই বৃষ্টির মধ্যে। ধীরস্থির ভাবে কাজ করতে অভ্যস্ত সে। আগে থেকেই আকাশকে দিয়ে মোটামুটি সব ব্যবস্থা করিয়ে রেখেছে। আকাশ চা তৈরি করে নিয়ে এলো। বৃষ্টি স্নান সেরে চা নিয়ে বসলো আকাশের সামনে। আকাশ চায়ে চুমুক দিতে দিতে তাকিয়ে আছে বৃষ্টির মুখের দিকে। ভেজা ভেজা চুল পিঠ জুড়ে ছড়ানো। বৃষ্টির মুখমন্ডল জুড়ে বিরাজ করছে স্নিগ্ধতা। মুখে লেগে আছে স্মিত হাসি। অপূর্ব লাগছে বৃষ্টিকে। আকাশ জিজ্ঞাসা করলো এখানে এসে কেমন লাগছে তোমার। বৃষ্টি বললো এখন নয় পরে বলবো। তুমি বাজার থেকে সব এনে রেখেছো তো মনে করে। এবার চলো চা টা শেষ করে লিস্টটা একবার মিলিয়ে নিই। চা পর্ব শেষ করে দুজনেই ব্যস্ত হয়ে পড়লো আমন্ত্রিত অতিথিদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করতে।
আগত অতিথিদের সম্ভাষণ ও আপ্যায়ন পর্ব মিটিয়ে শেষ বিকেলের দিকে ইকোপার্কের অপেক্ষাকৃত নির্জন একটি জায়গায় পাশাপাশি বসে আছে দুজনে। কোলাহলপূর্ণ পার্কের এই নির্জন জায়গাটা আকাশের খুব পছন্দের। দুজনে বহুবার এসেছে এই পার্কে। এই পার্কের জায়গায় জায়গায় প্রকৃতির মধ্যে ছড়িয়ে আছে এই যুগলের ভালোবাসার স্মৃতি। শুধু কি ভালোবাসা! দুজনের কত কলহ বিবাদ বিরহের সাক্ষী এই পার্কের প্রকৃতি। সেইসব স্মৃতিরোমন্থন করতে করতে দুজনেই আবেগপ্রবণ। বিকেলের শেষে সন্ধ্যার আঙ্গিনা পার করে সময় এগিয়ে চলেছে রাতের দিকে। আজকের কথা আগের দিনগুলোর থেকে আলাদা। তাদের আজ বাড়ি ফেরার কোনো তাড়া নেই। আগে আকাশ বৃষ্টিকে বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে দিয়ে ফিরে যেত নিজের গন্তব্যে। এখন থেকে সেসব অতীত। এখন তাদের গন্তব্যের একটাই ঠিকানা। বৃষ্টি আকাশের হাত ধরে ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে বললো সকালে তুমি জানতে চেয়েছিলে আমার কেমন লাগছে। আকাশ আমি খুব খুশি। এতদিন ধরে শুধু চেয়েছি আমরা কবে একসাথে থাকবো। নিজেদের ইচ্ছেগুলো কবে পূরণ করবো। মাঝে মাঝে খুব হতাশ লাগতো। আমরা কোনোদিনও পারবো তো একসাথে থাকতে! কতদিনের প্রতীক্ষার অবসান ঘটলো। আকাশ আজ আমাদের স্বপ্ন পূরণ হলো। এখনও অনেক পথ চলা বাকি। বাকি জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত তোমার সাথে তোমার কাছে থাকতে পারবো। তোমার খেয়াল রাখতে পারবো। এটুকুই তো চেয়েছিলাম। মাথার ওপরের খোলা আকাশের দিকে চেয়ে বৃষ্টি বললো আমাদের সম্পর্ক ওই আকাশ বৃষ্টির মতই নিবিড় ও গভীর হোক। ভালো থাকবো আমরা।
বৃষ্টিদের কমপ্লেক্সে অনেকটা ফাঁকা জায়গা আছে। সঙ্গে প্রচুর গাছ গাছালি। এদিকে ওদিকে বসার ব্যবস্থাও আছে। সেরকম এক জায়গায় বসে আছে সদ্য বিবাহিত তরুণ তরুণীটি। অন্যান্য ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের কারোর সাথেই আকাশ সেভাবে পরিচিত নয়। মুখ চেনা মাত্র। আকাশের সাথে অনেকেই আলাপ পরিচয় করেছে কিন্তু আকাশ সেই পরিচয় দীর্ঘায়িত করতে চায়নি। একটা গণ্ডির মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রেখেছে। অন্যান্য ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা যাতায়াতের পথে বেঞ্চে বসা থাকা কপোত কপোতীকে দেখে স্মিত হাসিতে অভিবাদন জানাচ্ছে। কেউ কেউ আবার কাছে এসে অভিনন্দন জানিয়ে গেলো। এসবের দিকে আকাশের কোনো ভ্রুক্ষেপ না থাকলেও বৃষ্টি হাসির প্রত্যুত্তরে হাসি বিনিময় করছে। বৃষ্টি জিজ্ঞাসা করলো কাল আমাদের ট্রেন কখন। আকাশ বলল রাত সাড়ে আটটায়। বৃষ্টি আক্ষেপের সুরে বলল আমরা কোথায় কোথায় যাব কোথায় থাকবো কোন কোন জায়গায় ঘুরবো কই এই নিয়ে তো কিছুই বললে না আমাকে। আকাশ বৃষ্টির চিবুকে আলতো স্পর্শ করে হেসে বললো সারপ্রাইজ। দেখো তোমার ভালো লাগবে। বৃষ্টি বলল আচ্ছা। চলো এবার উঠি। টুকিটাকি গোছগাছ বাকি আছে। আজ তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়বো। সকালে তাড়াতাড়ি উঠতে হবে। আকাশ বললো তুমি চলো আমি আসছি।
রাতের গাঢ় নিবিড় অন্ধকার ভেদ করে দুরন্ত গতিতে ছুটে চলেছে কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেস। গাঢ় অন্ধকারের বুক চিরে হঠাৎ আলোর আবির্ভাব ঘটছে তৎক্ষণাৎ আলোর রেখা আবার দূরে সরে গিয়ে অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে চারপাশ। খোলা জানালা দিয়ে ঠান্ডা বাতাস প্রবল বেগে এসে শরীরে শীতলতার পরশ দিয়ে যাচ্ছে। সারাদিনের গুমোট ভাবটা কেটে গেছে। হালকা বৃষ্টির ঝাপটা এসে লাগছে সাইড লোয়ার বার্থে বসা আকাশ ও বৃষ্টিকে। টিকিট কনফার্ম না হওয়ায় আকাশের চিন্তা হচ্ছিল। সকালের মেসেজে জানতে পারলো তাদের দুটো টিকিটই RAC হয়েছে। এতটা রাস্তা বসে বসে যেতে হবে। এই নিয়ে বেরোবার আগে অবধি দুজনের মধ্যে একটা চাপা অসন্তোষ থাকলেও এখন দুজনেই বেশ হাসি খুশি। ট্রেনের চাকা অনেকক্ষণ আগেই গড়াতে শুরু করছে। কিছুক্ষন আগেই বর্ধমান পার করে আরও গতি বাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে গন্তব্যের দিকে। সহযাত্রীরা খাওয়া দাওয়া সেরে নিজ নিজ বার্থে। যাত্রীদের আনাগোনা ও কোলাহলে ভাটা পড়েছে। অনেকেই যাওয়া আসা পথে টুক করে তাকিয়ে দেখে নিচ্ছে সিঁথিতে সদ্য সিঁদুর রাঙানো তরুণীটির দিকে। ব্যাপারটা আকাশের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। তবে আকাশ মজাই পাচ্ছে। গল্পগুজব হাসি ঠাট্টায় সময় পার হতে লাগলো। ওদের কামরায় আছে চারজনের একটা পরিবার। বাবা মা ও স্কুল পড়ুয়া দুই ভাই বোন। লোকটি ঘুমে কাতর। ভাই ও বোন একসাথে উদগ্রীব হয়ে মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে। মহিলাটি ছেলেমেয়ের শোয়ার ব্যবস্থা করে মোবাইলটি নিয়ে কথোপকথনে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ফোনের অপর প্রান্তের ব্যাক্তিকে নিজেদের যাত্রার ধারা বিবরণী শোনাতে লাগলেন। আর আছে কলেজ পড়ুয়া এক যুবতী এবং ঝকঝকে এক তরুণ। যুবতীর হাতে একটি বই। যুবতীটির চোখ বইয়ের পাতায় ঘোরাফেরা করছে। তরুণটি কিছুক্ষণ আগেই বর্ধমান থেকে উঠেছে। তরুণটির জোরালো আওয়াজ শুনে আকাশ ভাবলো তাকে বোধহয় কিছু বলছে। আকাশ তাকিয়ে বুঝতে পারলো সে ফোনেই কাকে কি যেনো বোঝানোর চেষ্টা করছে। মাঝে মাঝে উত্তেজিত হয়ে উচ্চস্বরে কথা বলছে। তরুণটি বেশ কয়েকবার তাকিয়েছে যুবতীটির দিকে। যুবতীর সাথে তরুণটির কোনো সম্পর্ক আছে কি না সে ব্যাপারে বৃষ্টির একটু কৌতুহল তৈরি হয়েছে। একবার যুবতীর দিকে তাকাতে গিয়ে বৃষ্টির চোখাচোখি হয়ে যায়। হালকা হাসিতে দুজন দুজনকে নীরব সম্ভাষণ জানিয়েছে। বৃষ্টিদের ওপরের বার্থ থেকে ভেসে আসা নাসিকা গর্জন মাঝে মধ্যে আর একজনের উপস্থিতি জানান দিয়ে যাচ্ছে। রাতের খাওয়া শেষ করে বৃষ্টি আর আকাশ ছুটন্ত ট্রেনের জানালার বাইরে দূরের অন্ধকারের মধ্যে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বসে আছে।
জানালার বাইরে তাকিয়ে আকাশ অন্ধকারের মধ্যেও যেনো কিছু দেখার বা খোঁজার চেষ্টা করছে। মুগ্ধ হয়ে আলো আঁধারের লুকোচুরি খেলা দেখছে সে। আকাশের ভাবুক চোখের দিকে তাকিয়ে বৃষ্টি বললো এই তুমি কি ভাবছো। আকাশ বললো কই কিছু না তো। বৃষ্টি আবার বললো বলো না কি ভাবছো। তোমাকে কেমন উদাস মনে হচ্ছে। আকাশ একটু হেসে বললো কই নাতো। আরও বলল ঐ যে দূরের দিকে তাকিয়ে দেখো। কেমন গাঢ় অন্ধকার। আবার একটু পরেই দেখবে সেই গাঢ় অন্ধকার একটু একটু করে সরে গিয়ে আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর আবার দেখবে সব আলো গ্রাস করে নিয়েছে অন্ধকার। আকাশের কথা শুনে বৃষ্টি উৎসুক ভাবে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলো। হঠাৎ ট্রেনের ঝাঁকুনিতে বৃষ্টি ভয় পেয়ে আকাশকে জিজ্ঞাসা করলো কি হলো! ট্রেনটা এমন জোরে ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল কেন। ও এমন কিছু না। এরকম মাঝে মাঝেই হয় বলল আকাশ। কেন এমন হয় শুনি বলে বৃষ্টি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো। আকাশ বলল অনেকরকম কারণে হতে পারে। ট্রেনের কাপলিং এর জন্য বা রেল ট্র্যাকের ইরেগুলার সারফেসের জন্য অথবা ট্রেন যখন ট্র্যাক চেঞ্জ করে তখন দুটো ট্র্যাকের জয়েন্ট একই লেভেলে না থাকলেও এমন হতে পারে। বৃষ্টি বললো আচ্ছা। ট্রেন আবার স্বাভাবিক ভাবে চলতে শুরু করেছে। বৃষ্টি আকাশের কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে যুবতী ও তরুণকে উদ্দেশ্য করে ফিসফিস করে বলল দেখো ছেলেটা কেমন বারবার মেয়েটার দিকে তাকাচ্ছে। মেয়েটাও সেটা খেয়াল করেছে। মাঝে মাঝে আড় চোখে ছেলেটাকে দেখছে। আকাশ বলল আর তুমি দেখছো ওদেরকে। বিরক্ত করো না ওদের। ওদেরকে ওদের মত থাকতে দাও। বৃষ্টি বললো হ্যাট আমি কি বিরক্ত করেছি নাকি। জানতো ওদের দেখে আমাদের নিজেদের অনেক অনেক পুরনো কথা মনে পরে যাচ্ছে। আকাশ বলল ওহঃ তাই বুঝি। তো কি কথা মনে পড়লো শুনি। বৃষ্টি বললো তুমিও তো কতবার একদৃষ্টিতে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে। আকাশ বলল কি করে জানলে। বৃষ্টি বলল বাঃ ভারী চমৎকার কথা তো। তুমি আমার দিকে তাকিয়ে থাকলে আমি ছাড়া কে জানবে। আকাশ বললো তাও ঠিক। এবার তুমি একটু ঘুমিয়ে নাও। বৃষ্টি শুয়ে পড়লে একপাশে বসে রইলো আকাশ। আকাশ খেয়াল করলো বকবক করতে করতে বৃষ্টি কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। বৃষ্টিকে ভালো করে চাদরটা ঢাকা দিয়ে দিল। আকাশ তাকিয়ে রইলো আলোছায়া মাখা বৃষ্টির মুখের দিকে আবার কখনো জানালা দিয়ে বাইরের দিকে।
ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। রাতের গাঢ় নিবিড় অন্ধকার দূরে সরে গেছে। সকাল ব্যাট প্যাড পরে মাঠে নামার অপেক্ষায়। যাত্রীদের ব্যস্ততা বেড়েছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কোলাহল। ট্রেন নিউ ম্যাল জংশনে থামলো। স্টেশন থেকে বেরিয়ে একটা গাড়িতে আকাশ ও বৃষ্টি পৌঁছে গেলো লাটাগুড়িতে। সাউথ গরুমারা ওয়াইল্ডলাইফ রেঞ্জের এক রিসর্টে গিয়ে উঠল। ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট খেতে খেতে আকাশ বলল দুপুরে খাবার পর বিশ্রাম নিয়ে বিকেলের দিকে আমরা জঙ্গল সাফারিতে যাবো। দুটো দিন ঘোরাঘুরি করে পরশু সন্ধ্যেতে আমাদের ফেরার ট্রেন। এই হলো আমাদের আমাদের সংক্ষিপ্ত ট্যুর প্ল্যান। বৃষ্টি বলল তুমি যেখানে নিয়ে যাবে সেখানেই যাবো। এখন তুমি স্নান করে একটু বিশ্রাম নাও। আর আমি চারপাশটা একটু ঘুরে দেখে আসি। আকাশ বলল সাবধানে যেও। বেশি দূরে যেও না। এখানে অনেক বিষাক্ত সাপ থাকে। বৃষ্টি রিসর্টের বাইরে বেরিয়ে এলো। প্রকৃতির মাঝে অনেকখানি জায়গা জুড়ে বেশ হাত পা ছড়িয়ে থাকার ব্যবস্থা এখানকার প্রতিটি রিসর্টে। সাধারন হোটেলের মত শুধু একটি মাত্র বিল্ডিং নয়। বরং বাঁশের কারুকার্য করা ছোট বড় বাড়ী বা কটেজ। এক একটি রিসর্টের সামনে অনেকখানি বাগান, নানারকম ফুলের গাছ, ছোটদের খেলার জায়গা। বৃষ্টি ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো বাগানে খুব সুন্দর নানা ধরণের ছোট বড় গাছ। হরেকরকম ফুল ফুটে আছে। গাছের কেয়ারী করা রাস্তা। পাখির খাঁচা। হাঁস মুরগীর স্বচ্ছন্দ বিচরণ। বাগানের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে তাদের প্যাঁক প্যাঁক আওয়াজ শুনতে শুনতে বৃষ্টির মনটা ভারী হাল্কা হয়ে গেল। বাগানের মধ্যেই বাঁধানো বসার জায়গা। দোলনায় দোল খেতে খেতে বৃষ্টি খুব উৎসাহিত হয়ে মনে মনে বলল চমৎকার। রিসর্টে ফিরে এসে বৃষ্টি দেখল আকাশ ঘুমিয়ে পড়েছে। এক পশলা হালকা বৃষ্টি হয়ে গেছে। দুপুরের খাওয়া সেরে আকাশের বুকে মাথা দিয়ে শুয়ে বৃষ্টি বলল জানো জায়গাটা ভারী সুন্দর। চারদিকে চা-বাগান তার মাঝে রিসর্ট। আর রিসর্টের মধ্যে আমরা। চা-বাগানের মাঝখান দিয়ে রাস্তা। চা-বাগান শেষ হলেই তারপরে গভীর জঙ্গল। মনে হচ্ছে যেন প্রকৃতির মধ্যে একেবারে একাত্ম হয়ে রয়েছি। আমার খুব ভালো লাগছে। বৃষ্টি তার মনের ভিতরে জমিয়ে রাখা ভালোবাসায় ভাসিয়ে দিল আকাশকে। ভালোবাসার অনাবিল আনন্দে ভেসে যেতে লাগলো দুটি তরুণ তরুণী।
নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে ফেরার ট্রেনে উঠেছে আকাশ ও বৃষ্টি। তিনদিন ধরে ঘোরাঘুরির পরেও বৃষ্টির শরীরে ক্লান্তির কোনো আভাস নেই। চোখে মুখে তরতাজা ভাব। মনে একটু বিষন্নতা। এখনও তার চোখে মুখে ভাসছে সুন্দরী ডুয়ার্সের প্রাকৃতিক দৃশ্য। বৃষ্টির সবসময় মনে হচ্ছে তার জন্যই প্রকৃতি নিজের ঝাঁপি খুলে দিয়েছিল। এমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য ছেড়ে আসতে একটু খারাপ লাগারই কথা। বৃষ্টির মনে প্রতিটি দৃশ্য এখনও ভাসমান। রিসর্টের একপাশে থাকা ওয়াচ টাওয়ার থেকে চারদিকের চা-বাগান। সেই বাগানের অপর প্রান্তে ভোরের সূর্যোদয়। দৃষ্টিপথ আবদ্ধ হয়ে যায় গহীন অরণ্যে। বৃষ্টি আপার বার্থ থেকে নিচে উঁকি দিয়ে দেখল আকাশ ঘুমিয়ে পড়েছে। কামরায় এক নিস্তব্ধ ভাব। বাতাসের আস্তরণকে ভেদ করে ট্রেন ছুটে চলেছে। কানে ভেসে আসছে বাতাসের শো শো শব্দ। বৃষ্টি আবার ফিরে গেল পিছনে ফেলে আসা প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যের মধ্যে।
চারিদিকে সবুজের সমাহার। জঙ্গল গভীর থেকে গভীরতর হতে শুরু করেছে। শাল সেগুন আরও কত রকমের গাছ গাছালি। আদিম সৌন্দর্য হল ঘনীভূত। আশ্চর্য রকমের এক নিরবতা। নিস্তব্ধ জঙ্গলে নীরবতার মাঝে নানা রকম পাখির ডাক ভেসে আসছে। নাম না জানা কিছু ছোট বড় পাখির উড়াউড়ি। বড় বড় গাছে জড়িয়ে আছে রং বেরংয়ের অর্কিড। গভীর নিস্তব্ধ অরণ্যের মধ্যে একটানা ঝিঁঝিঁর ডাক। অরণ্য যতই গভীর হচ্ছে ঝিঁঝিঁর ডাক যেনো বেড়েই চলেছে। চারিদিকে এক মায়াবী পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। মাঝে মাঝেই ছোট ছোট প্রাকৃতিক জলাশয়। যা বন্যপ্রাণীদের তৃষ্ণা নিবারণ করে। বৃষ্টির ভাবনায় ইতি পড়লো। ট্রেন থেমেছে কোনো স্টেশনে। যাত্রীদের উঠানামা চলছে। ঘুম ঘুম চোখে বৃষ্টি তাকিয়ে দেখে আকাশ দাঁড়িয়ে আছে ওর বার্থের পাশে। আকাশের দিকে তাকাতেই সে বলে উঠলো তুমি ঘুমাও নি। বৃষ্টি বলল ঘুমিয়েই তো ছিলাম। এই ঘুম ভেঙে গেলো। আমরা এখন কোথায় আছি বলতো। আকাশ বলল এই তো সবে মালদা। এখনও অনেক পথ বাকি। তুমি ঘুমিয়ে পড়ো। বৃষ্টি বলল হুমম। যাও তুমিও শুয়ে পড়ো। ট্রেন আবার চলতে শুরু করেছে। আকাশ ফিরে এল নিজের বার্থে। আর বৃষ্টি ফিরে গেলো ফেলা আসা প্রকৃতির কোলে।
ছবির মত সুন্দর রাস্তা। দুপাশে সবুজ গাছ গাছালি তার সঙ্গে বয়ে চলা জলের ধারা। আর দূরে দিগন্ত বিস্তৃত মেঘের আড়ালে ঢেকে থাকা ধুসর পাহাড়। সেই মেঘ আর পাহাড়ের ইচ্ছে না হলে পথিক দর্শন পায় না। রাস্তার দুপাশে বিস্তীর্ণ চা-বাগান। চা-বাগানের মধ্যে মধ্যে ছায়া প্রদানকারী বড় বড় গাছ। আরো এগিয়ে একসঙ্গে চা-বাগান নদী আর পাহাড়ের সমাবেশ। রাস্তার একদিকে চা-বাগান আর অন্যদিকে বেশ খানিকটা নীচ দিয়ে বয়ে চলেছে মূর্তি নদী। আর তার পরেই সবুজ পাহাড়ের রেঞ্জ। একদিকে চা-বাগানের নিস্তব্ধতা অন্য দিকে পাথরের মাঝ দিয়ে বয়ে চলা নদীর স্রোত। একদিকে চা-বাগান আর পাহাড়ের সবুজ অন্যদিকে নদীর পাথরের ধুসরতা। স্থির পাহাড়ের পাদদেশ বরাবর বয়ে চলা নদী। আরও কিছু দূর গিয়ে দৃশ্যপটের পরিবর্তন ঘটলো। এখানেও সেই মূর্তি নদী। কিন্তু জায়গাটির রূপ আলাদা। শয়ে শয়ে ছোট বড় পাথর। সেই সব পাথরের ওপর দিয়ে পাশ দিয়ে ফাঁক দিয়ে বিভিন্ন ভাবে বয়ে চলেছে মূর্তি। পাথরের বাধায় জল ছিটকে যাচ্ছে চারদিকে। জলের স্রোত সাদা ফেনায় পরিণত হচ্ছে। এখানে চা-বাগানের স্নিগ্ধতা নেই। আছে ঘন সবুজ পাহাড়ের কোল ঘেষে বয়ে চলা নদীর চঞ্চলতা। বৃষ্টি ও আকাশ পাথরের ওপর পা ফেলে ফেলে নদীর কাছে পৌঁছে গেল। আরও একটু এগিয়ে একটা বড় পাথরের ওপর গিয়ে দাঁড়ালো। পাথরের দুপাশ বেয়ে বইতে থাকে নদী। নদীর জলে পা ডুবিয়ে তারা কিছুক্ষণ বসে থাকে। সেই মুহূর্তে বৃষ্টির মনমধ্যে এই পাথরটাই যেন হয়ে যায় একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। যার চারপাশ দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে বয়ে যাচ্ছে মূর্তির জল। পাহাড়ে পাথরে জলেতে ফেনাতে এক আশ্চর্য জায়গা। ভাবতে ভাবতে বৃষ্টি পাড়ি দিল ঘুমের দেশে।
আকাশ আধশোয়া হয়ে ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরের দিকে চেয়ে আছে। দৃষ্টি সম্মুখের দিকে হলেও মনের গতিপথ অতীত গামী। আকাশের মনে পড়ে যাচ্ছে বৃষ্টির সাথে প্রথম দেখা। প্রথম পরিচয়ের দিনগুলোর কথা। তারপর দুজন দুজনকে চেনা। নিজেদের অজান্তেই দুজনের ভালোলাগা কবে কেমন করে ভালোবাসায় পরিণত হয়ে যাওয়া। আবার কাছে আসতে না আসতেই দূরে সরে যাওয়া। আকাশের সামনে ভেসে উঠলো সুদূর অতীতের বিশেষ এক দিনের কথা।
বড়দিনের সকাল। বেশ জাকিয়ে ঠান্ডা পড়েছে। শীতের আমেজ আকাশের মনে বসন্তের আগমনকে বাধা দিতে ব্যর্থ। মনের মধ্যে ফুরফুরে ভাব থাকলেও ভিতর ভিতর একটা টেনশন রয়েই গেছে। অপেক্ষা করে আছে বিকেলের জন্য। বারবার রিহার্সাল দিয়ে নিজেকে তৈরি করে নিচ্ছে। উৎকণ্ঠা তো অবশ্যই আছে। আজ বৃষ্টিকে নিজের মনের কথা বলার দিন। সেই জন্য দেখা করতে চেয়েছে বৃষ্টির সাথে। সারাটা দিন ধরে অধীর আগ্রহে যে সময়ের অপেক্ষা করেছে তা আসন্ন। শেষ বিকেলের দিকে বৃষ্টি তার দুই বান্ধবীর সাথে বেরিয়েছে আকাশের সাথে দেখা করতে। বাড়ি থেকে বেরোতে দেরি হয়ে যাওয়ায বৃষ্টি একটু দ্রুত পায়ে এগিয়ে চললো। চিঠিতে আকাশ লিখেছিলো খেলার মাঠের শেষপ্রান্তে বট গাছটার তলায় অপেক্ষা করবে সে। মাঠের কাছাকাছি এসে বৃষ্টি বন্ধবীদের বলল তোরা একটু ঘুরে আয়। আধঘন্টা পরে এখানেই আমার জন্য অপেক্ষা করবি। আমরা কিন্তু একসাথেই ফিরবো। বলেই বৃষ্টি দ্রুত পৌঁছে গেলো চিঠিতে লেখা ঠিকানায়। কই আকাশ তো নেই এখানে। এদিক ওদিক খুঁজতে লাগলো আকাশকে। কিন্তু কোথায় আকাশ! বৃষ্টি চিন্তা করতে লাগলো দেরি হয়েছে বলে আকাশ কি চলে গেলো! না কি আকাশ এখনও আসেই নি। সারা মাঠের কোথাও খুঁজে পেলো না আকাশকে। বৃষ্টির কান্না পেয়ে গেলো। কি করবে বুঝতে না পেরে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো বট গাছের তলায়। সন্ধ্যে ঘনিয়ে এসেছে। পাখিরা সব বাসায় ফিরে গেছে। কনকনে উত্তরে ঠান্ডা হওয়ায় কাঁপছে বৃষ্টি। বান্ধবীদের ঘরে ফেরার ডাক শুনতে পাচ্ছে। তবুও বৃষ্টি অপেক্ষা করে যাচ্ছে। অনেকটা সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে। আর কতক্ষন অপেক্ষা করবে সে। রাগে অভিমানে বৃষ্টি বাড়ি ফেরার পথ ধরলো। বৃষ্টি! বৃষ্টি! বৃষ্টি!… ডাক শুনে ফিরে তাকিয়ে দেখলো আকাশ উদভ্রান্তের মত ছুটে আসছে তার দিকে। চোখ মুখ ফোলা ফোলা। কি অসহায় লাগছে আকাশকে। কিছুই বুঝতে না পেরে তাকিয়ে রইলো আকাশের দিকে। আকাশ বৃষ্টির হাত ধরে ফেললো। ধরা ধরা গলায় বলল বৃষ্টি আজ তোমাকে অনেক কথা বলার ছিল। কিন্তু এখন আর বেশি সময় নেই। আমাকে আজই ফিরে যেতে হবে গ্রামের বাড়িতে। তোমার থেকে অনেকটা দূরে যেতে হবে। নিজের খুব প্রিয় এক অথিতির চিরবিদায় আসন্ন। আমি তাড়াতাড়ি ফিরে আসবো। বৃষ্টি আমি তোমাকে ভালোবাসি। তুমি আমার অপেক্ষায় থেকো। বৃষ্টি কোনো কথা বলারই সুযোগ পেলো না। যেমন ভাবে এসেছিল সেভাবেই চলে গেলো আকাশ।
ঘুম ভেঙে গেলো বৃষ্টির। প্রচন্ড এক ঝাঁকুনি সঙ্গে মানুষের তীক্ষ্ণ চিৎকার। কোলাহল। সঙ্গে বুকফাটা কান্না। গেল গেল! বাঁচাও বাঁচাও! চিৎকার! আর্তনাদ! ঘুম থেকে উঠে কিছুই বুঝতে না পেরে ফ্যাল ফ্যাল করে বৃষ্টি তাকিয়ে রইলো কামরার দিকে। বুঝতে পারলো ট্রেন আর চলছে না। যাত্রীদের মধ্যে হুলুস্থুল পরে গেছে। ট্রেনের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত দৌড়ঝাঁপ চলছে। কিন্তু আকাশ! আকাশ কোথায়! অ্যাকসিডেন্ট! অ্যাকসিডেন্ট! দুবার মাত্র কানে গেলো শব্দটা। বৃষ্টির চারিদিক কেমন অন্ধকার হয়ে আসছে। কানে কিছু শুনতে পাচ্ছে না সে। আকাশ কোথায় গেলো। চিৎকার করে বলতে চাইল আকাশ তুমি কোথায়। কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোলো না। সারা শরীর জুড়ে প্রচণ্ড ব্যাথা। অবশ হয়ে আসছে বৃষ্টির সারা শরীর। উঠবার ক্ষমতা টুকুও হারিয়েছে সে। মনে মনে বিড়বিড় করছে। অস্পষ্ট শব্দ শোনা যাচ্ছে। ক্ষনিকের স্তব্ধতা। কান্নায় ভেঙে পড়লো বৃষ্টি।
মধ্যরাত অতিক্রম করে সময় এখন ধীর গতিতে এগিয়ে চলেছে। জ্যোৎস্নার আলো কিছুটা ম্লান হয়ে এসেছে। চারিদিক নিস্তব্ধ। দূর থেকে ভেসে আসা কান্নার আওয়াজ আকাশের কান থেকে মস্তিকে পৌঁছে জাগিয়ে দিল তাকে। পাশে হাত দিয়ে বৃষ্টির উপস্থিতি টের পেল না। কান্নার আওয়াজ এখন আরও স্পষ্ট। উঠে বসল সে। বুকের ভিতর একটা শুন্যতা অনুভব করছে। আবছা আলোয় চেয়ারে বসা ছায়ামূর্তিকে দেখে কেমন যেন ভয় পেয়ে গেলো। কান্নার উৎসের দিকে এগিয়ে গেল। চেয়ারে হাত রাখতেই বৃষ্টির স্পর্শ পেলো। এ কি বৃষ্টি! তুমি কাঁদছো কেনো? কি হয়েছে তোমার? তুমি এখানে এভাবে বসে কেনো? বৃষ্টির মাথায় হাত রেখে বলল প্লিজ আমাকে বলো তোমার কি হয়েছে। বৃষ্টি পাগলের মত চোখে মুখে মাথায় হাত দিয়ে অনুভব করলো আকাশকে। জড়িয়ে ধরলো আকাশকে। বলতে লাগলো কথা দাও আকাশ আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না তুমি। কোনোদিনও আমাকে একা রেখে চলে যাবে না আকাশ। কিছুই বুঝতে না পেরে আকাশ বৃষ্টিকে ভরসা দিতে লাগলো। ঘরের আলোটা জ্বালিয়ে বৃষ্টির মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো খুব ভয় পেয়েছে সে। বৃষ্টি বললো প্লিজ আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করবে না। কথা দাও আজ আমি যা বলব তাই শুনবে। আকাশ বলল আচ্ছা শুনবো। বৃষ্টি তৎক্ষণাৎ আকাশের হাতে তুলে দিল তাদের ঘুরতে যাওয়া আসার ট্রেনের টিকিট দুটো। বলল এগুলো ছিঁড়ে ফেলো। আমরা কোথাও ঘুরতে যাব না। আমি তোমার সঙ্গে এখানেই থাকবো। কোথাও যাবো না। কোথাও না। আকাশ অবাক হয়ে বলল ঠিক আছে তাই হবে। প্রায় ভোর হয়ে এসেছে। চলো বৃষ্টি এবার একটু ঘুমিয়ে নাও। শুয়ে শুয়ে আকাশ স্পষ্ট শুনতে পেলো… বৃষ্টিই ঝরে পড়ে আকাশের বুক থেকে। আকাশ থেকে বৃষ্টি কখনো হারিয়ে যেতে পারে না।।
©ভিক্টর মল্লিক
মেনুতে যাবার জন্য
অনবদ্য ❤️
ধন্যবাদ
Thank you , For more article please visit https://crystalheartco.com/
Thank you , For more article please visit https://crystalheartco.com/
অসাধারণ,এমন অনেক গল্প পড়ার অপেক্ষায় রইলাম।
ধন্যবাদ
Thank you , For more article please visit https://crystalheartco.com/
Hi, Neat post. There’s a problem together with your website in internet explorer,
may test this? IE still is the marketplace leader and a huge component to other folks will omit your fantastic writing due to this problem.
No Thanks, Please try in other browser
Thank you , For more article please visit https://crystalheartco.com/
খুব সুন্দর হয়েছে লেখাটা ,আরও এইরকম গল্প পাওয়ার আশায় থাকলাম।
Thank you , For more article please visit https://crystalheartco.com/
Thank you , For more article please visit https://crystalheartco.com/