এই অধ্যায়ের আমরা দু ধরনের বল নিয়ে আলোচনা করব মহাকর্ষ বল এবং স্থির তড়িৎ বল ।
মহাকর্ষ (Gravitation)
বৃষ্টি কেন আকাশ থেকে পৃথিবীর দিকেই নেমে আসে? গাছের ঝড়া পাতা কেন মাটিতে এসেই পড়ে পৃথিবী কেন সূর্যের চারিদিকে ঘোরে? চাঁদ কেন গাছের পাতার মতো পৃথিবীর উপর এসে পড়ে না?
এই সকল প্রশ্নের উত্তর আমরা এই অধ্যায়ে খোঁজার চেষ্টা করব । তার আগে অভিকর্ষ তথা মহাকর্ষ সম্বন্ধে আমাদের একটা সম্মুখ ধারণা আমরা তৈরি করে নিই ।
মহাকর্ষ কাকে বলে?
মহাবিশ্বের যে-কোন দুটি বস্তুকণা পরস্পর পরস্পরকে যে বল দ্বারা আকর্ষণ করে, তাকে মহাকর্ষ বলে ।
বিজ্ঞানী স্যার আইজাক নিউটন এই মহাকর্ষ বলের মান কত হবে সেই সম্পর্কিত নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র আবিষ্কার করেন ।
নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র (Newton’s Law of Gravitation):
মহাবিশ্বের যে কোন দুটি বস্তুকণা পরস্পর পরস্পরকে তাদের সংযোজী সরলরেখা বরাবর আকর্ষণ করে এবং এই আকর্ষণ বলের মান বস্তুকণা দুটির ভরের গুণফলের সমানুপাতিক এবং ওদের মধ্যবর্তী দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতী ।

নিউটনের মহাকর্ষ সূত্রের গাণিতিক রূপ:
ধরা যাক, m1 ও m2 ভরের দুটি বস্তুকণার মধ্যবর্তী d । বস্ত দুটির মধ্যে পারস্পরিক আকর্ষণ বল F হলে, নিউটনের মহাকর্ষ সূত্রানুযায়ী,
F α m1m2 ; যখন d অপরিবর্তিত থাকেএবং
F α 1/d2 ; যখন m1 ও m2 অপরিবর্তিত থাকে ।
F α m1m2/d2 ; যখন m1 ও m2 এবং পরিবর্তিত হয় ।
বা, F = Gm1m2/d2 ;
এখানে G একটি ধ্রুবক সংখ্যা । G -কে সর্বজনীন মহাকর্ষীয় ধ্রুবক (Universal gravitational constant) বলা হয় বা সংক্ষেপে মহাকর্ষীয় ধ্রুবক বলা হয় ।
মহাকর্ষীয় ধ্রুবক (Gravitional Constant):
F = Gm1m2/d2 সমীকরণ থেকে আমরা লিখতে পারি, G = Fd2/m1m2
এই সমীকরণে, m1 = m2 = 1 একক এবং d = 1 একক বসিয়ে পাওয়া যায় G = F
এখান থেকে আমরা মহাকর্ষীয় ধ্রুবকের সংজ্ঞা বলতে পারি।
সংজ্ঞা: দুটি একক ভর বিশিষ্ট বস্তুকণা একক দূরত্ব থেকে পরস্পরকে যে বলে আকর্ষণ করে তাকে মহাকর্ষীয় ধ্রুবক বলে ।
মহাকর্ষীয় ধ্রুবকের (G) –এর একক:
G -এর একক = F-এর একক X (d-এর একক)2/ (m -এর একক)2
CGS পদ্ধতিতে একক: ডাইন সেমি2/গ্রাম2 (dyn cm2/g2)
SI পদ্ধতিতে একক: নিউটন মিটার2/কিগ্রা2 (N m2/kg2)
বিভিন্ন পরীক্ষার সাহায্যে G-এর মান হিসেব করে দেখা গেছে যে,
CGS পদ্ধতিতে G = 6.67X10-8 dyn cm2/g2
SI পদ্ধতিতে G = 6.67X10-11 N m2/kg2
মহাকর্ষ সূত্রের সার্বজনীনতা (Universality of the law of Gravitation):
নানাভাবে পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, দুটি বস্তুর মধ্যে মহাকর্ষীয় আকর্ষণ বল কেবলমাত্র বস্তু দুটির ভর ও তাদের মধ্যবর্তী দূরত্বের ওপর নির্ভর করে । এই আকর্ষণ বল বস্তু দুটির আকার (ছোট, বড়, পার্থিব বা জ্যোতিষ্ক), বস্তু দুটির অবস্থা (কঠিন, তরল বা বায়বীয়), রাসায়নিক উপাদান, উষ্ণতা, ওদের মধ্যবর্তী মাধ্যম ইত্যাদি কোন কিছুর উপরেই নির্ভর করে না । তাই নিউটনের মহাকর্ষ সূত্রকে সর্বজনীন বলা হয় ।
নিউটনের মহাকর্ষ সূত্রে দুটি বিন্দু বস্তুর কথা বলা হয়েছে । কিন্তু পৃথিবী সূর্য চাঁদ ইত্যাদি মোটেই বিন্দুবস্তু নয়, তাহলে এদের ক্ষেত্রে মহাকর্ষ সূত্র কিভাবে প্রয়োগ করা হবে?
দুটি বিস্তৃত বস্তু আকারে যত বড়ই হোক না কেন তাদের পারস্পরিক দূরত্ব যদি ওই আকারের তুলনায় খুব বেশি হয়, তাহলে ধরে নেওয়া চলে যে প্রতিটি বস্তুর সমগ্র ভর তার ভরকেন্দ্রে অবস্থিত । ফলে বিকৃত বস্তু দুটিকে আমরা ভ কেন্দ্রে অবস্থিত দুটি বস্তুকণা হিসেবে গণ্য করতে পারি । সুতরাং নিউটনের মহাকর্ষ সূত্রটির প্রয়োগেও আর জটিলতা থাকে না ।
বস্তুদুটির মধ্যবর্তী দূরত্ব (d) ক্রমশ বাড়ানো হলে মহাকর্ষ বলের (F) মানের কি পরিবর্তন ঘটবে?
আমরা জানি, F = G m1m2/d2
ভগ্নাংশ টির লব Gm1m2 স্থির, হর d যদি বৃদ্ধি পায় তবে Gm1m2/d2 -এর মান কমবে । অর্থাৎ বস্তু দুটির পারস্পরিক মহাকর্ষ বল, F কমবে ।এভাবে যদি d ক্রমাগত বাড়তে থাকে তবে F -এর মান কমতেই থাকবে। কিন্তু d -এর যত বড় মান আমরা নিই না কেন F -এর মান কখনই শূন্য হবে না ।
অর্থাৎ যে কোন বস্তুর মহাকর্ষীয় প্রভাব অসীম দুরত্ব পর্যন্ত বহাল থাকে । যদিও সেই প্রভাব যথেষ্ট ক্ষীণ হতে থাকে । তাই পৃথিবীর থেকে তুমি যত দূরেই যাও না কেন পৃথিবীর অভিকর্ষের প্রভাব সেখানেও থাকবেই । কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, একটা নির্দিষ্ট দূরত্বের পর মহাকর্ষীয় প্রভাব এত ক্ষীন হয়ে পড়ে যে তা প্রায় অনুভূতির বাইরে চলে যায় । তাই সেই দূরত্বের পর মহাকর্ষীয় প্রভাব প্রায় নেই ধরে নেওয়া হয় ।
অভিকর্ষ এবং অভিকর্ষজ ত্বরণ (Gravity and Acceleration due to Gravity)
অভিকর্ষ কাকে বলে?
ভূপৃষ্ঠে বা ভূ পৃষ্ঠের কাছাকাছি অবস্থিত কোন বস্তুকে পৃথিবী যে বল দ্বারা তার কেন্দ্রের দিকে আকর্ষণ করে তাকে অভিকর্ষ বলে । স্পষ্টতই অভিকর্ষ বল মহাকর্ষ বলেরই একটি বিশেষ রূপ মাত্র ।
এই অভিকর্ষ বলের জন্যই গাছ থেকে পাকা ফল মাটিতে পড়ে, কোন বস্তুকে উপর থেকে ছেড়ে দিলে পৃথিবীর দিকে ধাবিত হয় এবং বস্তুর ওজন পরিলক্ষিত হয়। সুতরাং অভিকর্ষ হল মহাকর্ষের একটি বিশেষ ক্ষেত্র ; পৃথিবীর মহাকর্ষকে অভিকর্ষ বলে ।

মনে করা যাক, পৃথিবীর ভর = M ব্যাসার্ধ = R এবং পৃথিবীর কেন্দ্র O থেকে r দূরত্বে m ভরের একটি বস্তু আছে। পৃথিবীকে আর R ব্যাসার্ধের সমসত্ত্ব গোলোক হিসেবে ধরে নিলে পৃথিবীর সমস্ত ভর M তার কেন্দ্রে কেন্দ্রীভূত আছে বলে ধরা যেতে পারে । তাহলে মহাকর্ষ সূত্র অনুসারে বস্তুটির উপর পৃথিবীর আকর্ষণ বল, অর্থাৎ অভিকর্ষ বলের পরিমাপ, F = GMm/r2
নিউটনের দ্বিতীয় গতিসূত্র অনুসারে বলা যায় যে, m ভরের বস্তুটির উপর F বল প্রযুক্ত হওয়ার ফলে বস্তুটির F -এর অভিমুখে অর্থাৎ ভূকেন্দ্রের দিকে একটি ত্বরণ সৃষ্টি হচ্ছে । এই ত্বরণ অভিকর্ষ বলের প্রভাবে উৎপন্ন । তাই এই ত্বরণকে অভিকর্ষজ ত্বরণ বলে । একে g দিয়ে সূচিত করা হয় ।
অভিকর্ষজ ত্বরণ: অভিকর্ষ বলের প্রভাবে অবাধে পতনশীল বস্তুতে যে ত্বরণের সৃষ্টি হয় তাকে অভিকর্ষজ ত্বরণ বলা হয় ।
মহাকর্ষীয় ধ্রুবক ও অভিকর্ষজ ত্বরণের মধ্যে সম্পর্ক (G ও g এর মধ্যে সম্পর্ক):
নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র থেকে, F = GMm/r2
নিউটনের দ্বিতীয় গতি সূত্র থেকে, F = ma = mg [বল = ভর X ত্বরণ]
∴ mg = GMm/r2
g = GM/r2
যেহেতু G ও M উভয়ই ধ্রুবক রাশি তাই g α 1/r2
অর্থাৎ, ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি অবস্থিত কোন বিন্দুতে অভিকর্ষজ ত্বরণের মান পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে ঐ বিন্দুর দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক ।
অভিকর্ষজ ত্বরণের সমীকরণ থেকে আমরা দেখতে পাই যে, কোন স্থানে অভিকর্ষজ ত্বরণের মান বস্তুর ভরের উপর নির্ভর করে না । কোন নির্দিষ্ট স্থানে হালকা বা ভারী সব বস্তুর ক্ষেত্রেই অভিকর্ষ ত্বরণের মান সমান অর্থাৎ পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে সম দূরবর্তী স্থানসমূহে অভিকর্ষ ত্বরণের (g) মান একই ।
ভূপৃষ্ঠের উপরিস্থিত যেকোন বিন্দুর ক্ষেত্রে r = R হয় । সেক্ষেত্রে ভূপৃষ্ঠে অভিকর্ষজ ত্বরণের সমীকরণ g = GM/R2
উপরের সমীকরণ থেকে আমরা বলতে পারি যে, একক ভরের বস্তুর উপর অভিকর্ষ বলের মান ও অভিকর্ষজ ত্বরণের মান সমান ।
CGS পদ্ধতিতে g -এর গড় মান 980 cm/s2 এবং SI পদ্ধতিতে g -এর গড় মান 9.8 m/s2 ।
পৃথিবীর সব স্থানে অভিকর্ষ ত্বরণের মান কি সমান?
পৃথিবীর সর্বত্র অভিকর্ষজ ত্বরণের মান সমান নয় । নিম্নলিখিত কারণগুলির জন্য এর মান পরিবর্তিত হয় :
(I) পৃথিবী উপগোলকাকার হওয়ার জন্য ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন স্থানে g -এর মান বিভিন্ন হয় । (II) ভূপৃষ্ঠ থেকে বিভিন্ন উচ্চতায় g -এর মান বিভিন্ন হয় । (III) ভূপৃষ্ঠ থেকে বিভিন্ন গভীরতায় g -এর মান বিভিন্ন হয় । (IV) পৃথিবীর আহ্নিক গতির জন্য ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন স্থানে g -এর মান বিভিন্ন হয় ।
প্রমাণ কর যে, ভূপৃষ্ঠের কোন স্থানে m ভরের কোন বস্তুর ওজন W = mg (g = অভিকর্ষজ ত্বরণ) ।
ধরা যাক, পৃথিবীর ভর = M এবং ব্যাসার্ধ = R
m বস্তুর উপর ক্রিয়াশীল মহাকর্ষ বল F = GMm/R2
অভিকর্ষজ ত্বরণ g = F/m = GM/R2
m -ভরের বস্তুর উপর ক্রিয়াশীল পৃথিবীর অভিকর্ষ বলের মানকে ওই বস্তুর ওজন বলে । m – ভরের বস্তুর ওজন (Weight) W হলে ,
W = GMm/R2 = m. (GM/R2) = mg
∴ W = mg
অর্থাৎ, বস্তুর ওজন = বস্তুর ভর X অভিকর্ষজ ত্বরণ ।
পৃথিবীর সব স্থানে কোন বস্তুর ওজন সমান হবে কি?
আমরা জানি, m ভরের বস্তুর ওজন W = mg
পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে g -এর মান বিভিন্ন হওয়ার কারণে বস্তুর ওজন বিভিন্ন জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন হয় ।
একটি বস্তু ও পৃথিবীর মধ্যে আকর্ষণ বল সমান হলেও বস্তুটি পৃথিবীর দিকে এগিয়ে যায় পৃথিবী বস্তুর দিকে নয় কেন?
এই ঘটনার ব্যাখ্যা আমরা অভিকর্ষজ ত্বরণের সাহায্য করতে পারি ।
ধরা যাক, পৃথিবীর ভর = M, বস্তুর ভর = m এবং পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে বস্তুটি r দূরত্বে আছে ।
পৃথিবী বস্তুকে F = GMm/r2 বল দিয়ে নিজের কেন্দ্রের দিকে আকর্ষণ করলে নিউটনের তৃতীয় গতিসূত্র অনুযায়ী বস্তুও পৃথিবীকে একই বল F দিয়ে নিজের দিকে আকর্ষণ করবে ।
নিউটনের দ্বিতীয় গতিসূত্র অনুযায়ী,
বস্তুর ত্বরণ = বস্তুর উপর প্রযুক্ত বল / বস্তুর ভর = F/M = GM/r2
পৃথিবীর ত্বরণ = পৃথিবীর উপর প্রযুক্ত বল / পৃথিবীর ভর = F/M = Gm/r2
সুতরাং, বস্তুর ত্বরণ / পৃথিবীর ত্বরণ = M / m
যেহেতু পৃথিবীর ভর (M) বস্তুর ভর (m) -এর তুলনায় বহুগুণ বেশি ( অর্থাৎ, M >>> m), তাই বস্তুর ত্বরণ পৃথিবীর ত্বরণের তুলনায় বহুগুণ বেশি হবে । সুতরাং বস্তু পৃথিবীর দিকে অগ্রসর হবে, পৃথিবী বস্তুর দিকে অগ্রসর হবে না ।
পৃথিবীর উপর প্রতিটি বস্তু পরস্পরকে আকর্ষণ করছে তাহলে তাদের একে অপরের সঙ্গে ঠোকাঠুকি লাগা উচিত । কিন্তু বাস্তবে তা হয় না । কেন?
ধরা যাক, পৃথিবীর ভর = M, দুটি সম ভরের বস্তুর ভর m। বস্তুদুটির মধ্যবর্তী দূরত্ব d পৃথিবী ও বস্তু দ্বয়ের মধ্যবর্তী দূরত্ব r ।
এখন, বস্তু দুটির মধ্যে ক্রিয়াশীল আকর্ষণ বল F1 = Gmm/d2
আবার, পৃথিবী ও যে কোন একটি বস্তুর মধ্যে ক্রিয়াশীল আকর্ষণ বল F2 = GMm/r2
এখন, F2/F1 = M/m x d2/r2
এখানে, পৃথিবীর ভর বস্তুর ভরের থেকে বহুগুণ বেশী (অর্থাৎ, M >>> m) এবং r >> d তাই
F2 >>> F1
অর্থাৎ বস্তু দুটির মধ্যে পারস্পরিক আকর্ষণ বলের তুলনায় পৃথিবী যে পরিমাণ বল দ্বারা দুটি বস্তুকে টানে তা এতটাই নগণ্য যে তার কোন প্রভাব বোঝা যায় না ।
পতনশীল বস্তুর সূত্রাবলী ( Laws of falling bodies ) :
কোন বস্তুকে ভূপৃষ্ঠের কিছুটা উপর থেকে ছেড়ে দিলে অভিকর্ষ বলের প্রভাবে সেটি উলম্ব পথে নিচের দিকে পড়ে । প্রতিদিন আমাদের জীবনে আমরা এমন ধরনের বহু পতনশীল বস্তুকে দেখে থাকি। সাধারণত কোনো বস্তু স্থির অবস্থান থেকে অথবা কিছুটা প্রাথমিক বেগ নিয়ে যাত্রা শুরু করতে পারে। বস্তুটি পড়ার সময় তার গতির বিপরীত দিকে বায়ুর বাধা অনুভব করে । বিভিন্ন পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বিজ্ঞানী গ্যালিলিও দুটি শর্ত সাপেক্ষে পতনশীল বস্তুর সূত্রগুলি প্রতিষ্ঠা করেন ।
(i) প্রতিটি বস্তু স্থির অবস্থান থেকে যাত্রা শুরু করে অর্থাৎ প্রতিটি বস্তুর প্রাথমিক বেগ শূন্য হয় ।
(ii) প্রতিটি বস্তুর নিম্নমুখী গতিতে বায়ুর বাধা উপেক্ষণীয় বা গতির বিরুদ্ধে অন্য কোন ধরনের বাধা অনুপস্থিত ।
যে বস্তু এই শর্ত দুটি পূরণ করে তাকে স্থির অবস্থান থেকে অবাধে পতনশীল বস্তু বলা হয় ।
পতনশীল বস্তুর সূত্রগুলি:
প্রথম সূত্র: স্থির অবস্থা থেকে অবাধ পতনশীল সকল বস্তুই সমান দ্রুততায় নিচে নামে ।
ব্যাখ্যা: কোন উঁচু জায়গা থেকে ঢিল ও একটি কাগজের টুকরো একসঙ্গে ছেড়ে দিলে ঢিলটি মাটিতে অনেক আগে পৌছায় । এই ধরনের প্রাথমিক ঘটনাবলীর জন্যই আগে লোকেরই ধারনা ছিল হালকা বস্তুর চেয়ে ভারী বস্তু দ্রুততায় নিচে নামে । গ্যালিলিওর প্রথম পিসার হেলানো মিনার এর উপর থেকে বিভিন্ন ওজনের বস্তুকে নিচে ফেলে দেখান যে মাটিতে পৌঁছাতে তাদের একই সময় লাগে। তিনি বলেন, বায়ুর বাধা না থাকলে বস্তুগুলি মাটিতে পৌঁছাতে একই সময় লাগতো, সময়ের কোনো হেরফের হতো না । পরে বিজ্ঞানী নিউটন তার বিখ্যাত গিনি ও পালক এর পরীক্ষার সাহায্যে গ্যালিলিওর এই সূত্রটি প্রমাণ করেন ।
দ্বিতীয় সূত্র: স্থির অবস্থ থেকে অবাধ পতনশীল বস্তুর ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট সময়ে বস্তু যে বেগ লাভ করে তা বস্তুটির পতনকালের সমানুপাতিক ।
অর্থাৎ t সময় অর্জিত বেগ v হলে , v∝t
তৃতীয় সূত্র: স্থির অবস্থা থেকে অবাধ পতনশীল বস্তুর ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট সময়ে বস্তু যে দূরত্ব অতিক্রম করে তা বস্তুটির পতনকালের বর্গের সমানুপাতিক ।
অর্থাৎ t সময়ে অতিক্রান্ত দূরত্ব h হলে , h∝t2
অবাধে পতনশীল বস্তুর ওজন নেই – ব্যাখ্যা করো।
কোন বস্তুর ওজন আমরা তখনই অনুভব করি যখন বস্তুর উপর ক্রিয়াশীল পৃথিবীর আকর্ষণ বলকে আমরা বাধা দিই । মাথায় কোন বোঝা চাপালে আমরা ওজন অনুভব করি কারণ পৃথিবী বোঝার উপর যে আকর্ষণ বল প্রয়োগ করে সেই আকর্ষণ বলকে বাধা দিই । কিন্তু মাথায় বোঝা নিয়ে কোন ব্যক্তি কোন উঁচু স্থান থেকে নিচে লাফ দিলে যতক্ষণ সে শূন্যে থাকে ততক্ষণ পৃথিবীর আকর্ষণ বল কে বাধা দেওয়া সম্ভব হয় না । তাই সে মাথায় বোঝার ভার অনুভব করে না। সুতরাং আমরা এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে অবাধে পতনশীল অবস্থায় বস্তুর ওজন শূন্য হয়।
গাণিতিকভাবে ব্যাখ্যা:
ধরা যাক, f ত্বরণে পতনশীল কোনো m ভরের বস্তু একটি কাল্পনিক তলের উপর অবস্থিত। অর্থাৎ কাল্পনিক তলসহ বস্তুর অভিকর্ষ বলের প্রভাবে f ত্বরণে নিচে নামছে। তলটি দ্বারা বস্তুর উপর ক্রিয়াশীল প্রতিক্রিয়া বল R হলে ,
mg−R=mf
বা, R=m(g−f)
বস্তুটি অবাধে পতনশীল হলে f=g
হবে এবং সেক্ষেত্রে R=m(g−g)=0
সুতরাং তলটি দ্বারা বস্তুর উপর ক্রিয়াশীল প্রতিক্রিয়া বল 0 অর্থাৎ সেক্ষেত্রে বস্তুটির ওজন শূন্য হয় ।


একটি পাথরের টুকরোকে সোজা উপরের দিকে ছুড়ে দিলে পাথরটি আবার তোমার হাতে ফিরে আসবে । কেন?
টিকে যখন উপরের দিকে ছুড়ে দেওয়া হয় সেই অবস্থায় পাথরটির উপর অভিকর্ষ বল নিচের দিকে ক্রিয়াশীল হয়। ফলে পাথরটির ঊর্ধ্বমুখী বেগ ক্রমশ কমতে থাকে এবং সর্বোচ্চ উচ্চতায় পাথরটির বেগ শূন্য হয় । তখন অভিকর্ষের টানে পাথরটি আবার নিচে ফিরে আসে ।
একটি পাথরকে ভূমির সমান্তরালে ছুড়ে দিলে পাথরটি কিভাবে ফিরে আসে তার ছবিতে দেখতে পাচ্ছ । পাথরটির গতিপথ কেন এরকম হয়?
এক্ষেত্রেও অভিকর্ষ বল টান সব সময় ভূমির দিকে কাজ করে । অভিকর্ষের টানে প্রতিমুহূর্তে পাথরের বেগের দিক পরিবর্তিত হচ্ছে এবং বস্তুটি এইরকম একটি গতিপথে নিচে ফিরে আসে ।পৃথিবী থেকে পাঠানো কৃত্রিম উপগ্রহকে এভাবেই ছোড়ার ফলে তা পৃথিবীকে ঘুরতে থাকে ।
মুক্তি বেগ (Escape Velocity):
আমরা জানি কোন বস্তুকে ভূপৃষ্ঠ থেকে উপরের দিকে ছুড়ে দিলে বস্তুটি সর্বোচ্চ উচ্চতায় পৌঁছে আবার অভিকর্ষের টানে পৃথিবীতে ফিরে আসে । বস্তুটির প্রক্ষেপে বেগ ক্রমশ বাড়াতে থাকলে এমন একটি অবস্থা আসে যখন সর্বোচ্চ উচ্চতায় বস্তুটির গতিবেগ আর শূন্য হয় না ফলে সেটি আর ভূপৃষ্ঠে ফিরে আসে না । এক্ষেত্রে বস্তুটি পৃথিবীর থেকে ক্রমশ দূরে চলে যেতে থাকে এবং বস্তুটির উপর পৃথিবীর মহাকর্ষীয় আকর্ষণ বল ক্রমশ নগণ্য হতে থাকে । সুতরাং আমরা বলতে পারি বস্তুটি পৃথিবী থেকে অসীম দূরত্বে পৌঁছে যায় । এই ঘটনা ঘটানোর জন্য যে নূন্যতম প্রক্ষেপ বেগের প্রয়োজন তাই হল মুক্তিবেগ ।
সংজ্ঞা: যে ন্যূনতম বেগে ছুড়লে কোন বস্তু পৃথিবীপৃষ্ঠ বা অন্য কোন গ্রহ বা উপগ্রহের পৃষ্ঠ থেকে তার মহাকর্ষীয় আকর্ষণের বাইরে চলে যেতে পারে তাকে মুক্তি বেগ বলে ।
পৃথিবীর ক্ষেত্রে মুক্তিবেগের মান 11.2 km/s
অর্থাৎ পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে কোন বস্তুকে নূন্যতম 11.2 km/s বেগে উপরের দিকে ছোড়া হলে বস্তুটি পৃথিবীর আকর্ষণের বাইরে চলে যায় ।
Click link below for online Mock Test