অণুর ধারণা (Concept of Molecule):
ইতালীয় বিজ্ঞানী অ্যামিদিও অ্যাভোগাড্রো সর্বপ্রথম মৌলিক পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণা ও গ্যাসের ক্ষুদ্রতম কণার মধ্যে পার্থক্য কল্পনা করে অনুবাদ প্রবর্তন করেন। তার মত অনুযায়ী দূরত্ব ক্ষুদ্রতম কণা দিয়ে বিভিন্ন পদার্থ গঠিত হয়েছে যথা পরমাণু এবং অনু। অ্যাভোগাড্রো র মতে পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণা হলো পরমাণু, পরমাণুর স্বাধীন সত্তা নাও থাকতে পারে এবং পরমাণুই রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পদার্থের ধর্ম পরমাণুর ধর্ম থেকে ভিন্ন।
(i) গ্যাসীয় মৌলের পরমাণু সাধারণত একা থাকতে পারেনা দুটি করে পরমাণু একসঙ্গে জোট বেঁধে থাকে।
(ii) যৌগিক পদার্থের কণাগুলিতে বিভিন্ন মৌলিক পদার্থের পরমাণু গুলি জোটবদ্ধ অবস্থায় থাকে।
মৌলিক বা যৌগিক পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণা, যা স্বাধীনভাবে থাকতে পারে, যার মধ্যে পদার্থের সব ধর্ম বর্তমান থাকে তাকে অণু বলে। বিভিন্ন মৌল বা যৌগ এইরকম কণা দিয়ে তৈরি। পরমাণুগুলি একসঙ্গে জোট বেঁধে বিভিন্ন মৌল বা যৌগের এইরকম কণা গঠন করে – অ্যাভোগাড্রো সেই কণার নাম দেন অণু (Molecule)।
অর্থাৎ সব পদার্থই কতকগুলি পৃথক বা বিচ্ছিন্ন এবং স্বাধীন সত্তাসম্পন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণার সমন্বয়ে গঠিত। পদার্থের সব ধর্মই কণাগুলোর মধ্যে বর্তমান থাকে। এইরকম কণাগুলোকে অণু বলে।
ডালটনের পরমাণুর কল্পনাকে বজায় রেখে তিনি অণুর কল্পনার প্রবর্তন করেন। তার মতে পরমাণু কণার সংযোগে অণু গঠিত।
অণু দুরকম – মৌলিক অণু এবং যৌগিক অণু।
মৌলিক অণু (Elementary molecule): একই মৌলিক পদার্থের পরমাণু দ্বারা গঠিত অণুকে মৌলিক অণু বলে।
যেমন – Na, K, Ca, Al, Fe ইত্যাদি ধাতব মৌলের এবং C, B, Si ইত্যাদি অধাতব মৌলিক পদার্থের অণুগুলি একটি করে পরমাণু দ্বারা গঠিত। এক্ষেত্রে অণু ও পরমাণুর একই অর্থ বোঝায়।
আবার H2, O2, N2, Cl2 ইত্যাদি গ্যাসীয় মৌলের অণুগুলির দুটি করে পরমাণু দ্বারা গঠিত।
নিষ্ক্রিয় গ্যাসের (He, Ne, Ar) অণু একটি করে পরমাণু দ্বারা গঠিত।
যৌগিক অণু(Compound molecule): যৌগিক পদার্থের ক্ষুদ্রতম স্বাধীন কণা অর্থাৎ অণু একাধিক মৌলিক পদার্থের একটি বা তার বেশি সংখ্যক পরমাণু দ্বারা গঠিত এইরকম অণুকে যৌগিক অণু বলে।
যেমন – দুটি হাইড্রোজেন ও একটি অক্সিজেন পরমাণু দিয়ে তৈরি হয় জলের (H2O)একটি অণু। একটি হাইড্রোজেন, একটি নাইট্রোজেন ও তিনটি অক্সিজেন পরমাণু দিয়ে তৈরি হয় নাইট্রিক অ্যাসিডের (HNO3) একটি অণু। একটি কার্বন ও দুটি অক্সিজেন পরমাণু দিয়ে গঠিত হয় কার্বন-ডাই-অক্সাইডের (CO2)একটি অণু।
পারমাণবিকতা (Atomicity): কোনো মৌলের একটি অণু যত সংখ্যক পরমাণু দ্বারা গঠিত সেই সংখ্যাকে ওই মৌলের পারমাণবিকতা বলে।
যেমন – Na, Mg, He এদের পারমানবিকতা = 1, H2, O2, Cl2 এদের পারমাণবিকতা = 2, ওজনের (O3) পারমানবিকতা = 3 ।
অ্যাভোগাড্রোর প্রকল্প (Avogadro’s Hypothesis):
একই চাপ ও তাপমাত্রায় সম-আয়তন সব গ্যাসের মধ্যে সমান সংখ্যক অণু বর্তমান থাকে।
এই প্রকল্প অনুযায়ী একই চাপ ও তাপমাত্রায় 1 cc অক্সিজেন গ্যাসের মধ্যে যদি n সংখ্যক অণু বর্তমান থাকে, তাহলে ওই চাপ ও তাপমাত্রায় 1 cc ক্লোরিন, 1 cc হাইড্রোজেন, 1 cc কার্বন-ডাই-অক্সাইড বা 1 cc অ্যামোনিয়ার মধ্যেও n সংখ্যক অণু বর্তমান থাকবে। অর্থাৎ একই চাপ ও তাপমাত্রায় 1cc যে কোন মৌলিক বা যৌগিক গ্যাসীয় পদার্থে সমান সংখ্যক অণু বর্তমান থাকে।
মনে রাখতে হবে অ্যাভোগাড্রো প্রকল্প বলে না যে, বিভিন্ন গ্যাসের অণগুলি সব একই আয়তনের হয়। এই প্রকল্পে বলা হয় যে বিভিন্ন গ্যাসের যে যে আয়তনে সমান সংখ্যক অনু থাকে সেই সেই আয়তন সমান হয়। বিভিন্ন গ্যাসের অনুগুলির আয়তন কিন্তু বিভিন্ন।
গ্রাম-পারমানবিক ওজন (Gram atomic weight) বা গ্রাম-পরমাণু (gram atom):
কোন মৌলিক পদার্থের পারমাণবিক ওজনকে গ্রামে প্রকাশ করলে যত গ্রাম হয়, তত গ্রাম ওজনের মৌলিক পদার্থকে পদার্থটির এক গ্রাম পরমাণু বা গ্রাম-পারমাণবিক ওজন বলে।
যেমন – অক্সিজেনের পারমাণবিক গুরুত্ব 16; সুতরাং অক্সিজেনের গ্রাম-পারমাণবিক ওজন 16 গ্রাম। অতএব 1 গ্রাম-পরমাণু অক্সিজেন বলতে আমরা 16 গ্রাম অক্সিজেনকে বুঝবো। আবার 2 গ্রাম- পরমাণু অক্সিজেন বলতে 32 গ্রাম অক্সিজেনকে বোঝায়।
গ্রাম-আণবিক গুরুত্ব (Gram molecular weight) বা গ্রাম-অনু (Gram molecule) বা গ্রাম-মোল (Gram mole):
কোন মৌলিক বা যৌগিক পদার্থের আণবিক ওজনকে গ্রামে প্রকাশ করা হলে যত গ্রাম হয়, তত গ্রাম ওজনের পদার্থকে ওই পদার্থের গ্রাম-অণু বা গ্রাম-মোল বলে, আর সেই ওজনকে গ্রাম-আণবিক ওজন বলে।
যেমন অক্সিজেনের আণবিক ওজন 32; সুতরাং অক্সিজেনের গ্রাম-আণবিক ওজন বা 1 গ্রাম-অণু অক্সিজেন বা এক মোল অক্সিজেন বলতে আমরা 32 গ্রাম অক্সিজেনকে বুঝি। আবার জলের (H2O) আণবিক ওজন =(1×2+16)= 18 অর্থাৎ জলের গ্রাম-আণবিক ওজন = 18 গ্রাম।
গ্রাম-আণবিক আয়তন বা মোলার আয়তন (Molar volume):
নির্দিষ্ট উষ্ণতা ও চাপে 1 গ্রাম-অণু পরিমাণ কোন গ্যাস যে আয়তন অধিকার করে, তাকে গ্যাসটির গ্রাম-আণবিক আয়তন বা মোলার আয়তন বলে। প্রমাণ চাপ ও তাপমাত্রায় (N.T.P.) যে কোন গ্যাসের গ্রাম-আণবিক আয়তন বা মোলার আয়তন 22.4 লিটার। অর্থাৎ 1 গ্রাম-অণু বা 32 গ্রাম অক্সিজেনের N.T.P. তে আয়তন 22.4 লিটার।
Cl, 2Cl, Cl2, 3Cl2 – বলতে কি বোঝায়?
Cl এবং 2Cl -এর দ্বারা যথাক্রমে 1-টি ও 2-টি ক্লোরিন পরমাণুকে বোঝায়। Cl2 এবং 3Cl2 সংকেত দ্বারা যথাক্রমে ক্লোরিনের 1-টি ও 3-টি অণুকে বোঝায়।
ক্লোরিনের পারমাণবিক ওজন 35.5 । অতএব Cl এবং 2Cl দ্বারা যথাক্রমে 35.5 গ্রাম এবং 71 গ্রাম ক্লোরিনকে বোঝায়। ক্লোরিনের আণবিক ওজন (2×35.5) বা 71। Cl2 এবং 3Cl2 যথাক্রমে 71গ্রাম এবং (3×71) বা 213 গ্রাম ক্লোরিনকে প্রকাশ করে।
অ্যামোনিয়াম ফসফেটের একটি অণুতে কটি পরমাণু আছে?
অ্যামোনিয়াম ফসফেটের সংকেত হল (NH4)3PO4
(NH4)3PO4 যৌগের অণুতে পরমাণুর সংখ্যা = 3(1+4)+1+(4X1) = 20
Na2CO3, 10H2O যৌগের গ্রাম আণবিক ওজন কত? (Na=23, C=12, O=16, H=1)
Na2CO3, 10H2O যৌগের গ্রাম আণবিক ওজন =(2×23+12+3×16)+10(2×1+16) = 286 গ্রাম।
অ্যাভোগাড্রো সংখ্যা (Avogadro number):
মৌলিক বা যৌগিক যেকোন পদার্থের এক গ্রাম অণু পরিমানের মধ্যে সমান সংখ্যক অনু বর্তমান থাকে এই সংখ্যাকে অ্যাভোগাড্রো সংখ্যা বলে। এই সংখ্যাটিকে NA অক্ষর দ্বারা প্রকাশ করা হয়। অ্যাভোগাড্রো সংখ্যা NA = 6.022X1023
অ্যাভোগাড্রো সংখ্যা কেবলমাত্র পদার্থের অনুর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। যেকোনো পদার্থের এক গ্রাম পরমাণুতে পরমাণুর সংখ্যা বা এক গ্রাম আয়নে আয়নের সংখ্যাও অ্যাভোগাড্রো সংখ্যার সমান। সুতরাং, বলা যায় যে 1 গ্রাম-অণুতে অণুর সংখ্যা = 1 গ্রাম-পরমাণুতে পরমাণুর সংখ্যা = 1 গ্রাম-আয়নে আয়নের সংখ্যা = 6.022X1023
1 গ্রাম অক্সিজেন অণু অর্থাৎ 32 গ্রাম অক্সিজেনে অণুর সংখ্যা = 6.022X1023
12 গ্রাম কার্বনের মধ্যে কার্বন পরমাণুর সংখ্যা = 6.022X1023।
আবার S.T.P. তে এক গ্রাম-অণু গ্যাসীয় পদার্থের আয়তন = 22.4 লিটার। সুতরাং বলা যায়- S.T.P. -তে 22.4 লিটার আয়তনের গ্যাসের মধ্যে যত সংখ্যক অণু থাকে সেই সংখ্যাকেও অ্যাভোগাড্রো সংখ্যা বলে।
মৌলিক বা যৌগিক পদার্থ | এক গ্রাম অণুর পরিমাণ | গ্যাসীয় হলে S.T.P. – তে আয়তন | উপস্থিত অণুর সংখ্যা | |
হাইড্রোজেন (H2) | 2 গ্রাম | 22.4 লিটার | 6.022 x 1023 | |
অ্যামোনিয়া (NH3) | 17 গ্রাম | |||
নাইট্রোজেন (N2) | 28 গ্রাম | |||
অক্সিজেন (O2) | 32 গ্রাম | |||
কার্বন–ডাই–অক্সাইড (CO2) | 44 গ্রাম | |||
সালফার–ডাই–অক্সাইড (SO2) | 64 গ্রাম | |||
যে কোন কঠিন বা তরল পদার্থ | G গ্রাম (ধরি) | _____ | 6.022 x 1023 |
মৌলিক পদার্থ | এক গ্রাম অণুর পরিমাণ | উপস্থিত অণুর সংখ্যা | |
অক্সিজেন (O) | 16 গ্রাম | 6.022 x 1023 | |
কার্বন (C) | 12 গ্রাম | ||
ব্রোমিন (Br) | 80 গ্রাম | ||
ম্যাগনেসিয়াম (Mg) | 24 গ্রাম |
মোলের ধারণা (Concept of mole):
কোন পদার্থের (মৌল বা যৌগ বা আয়ন) এক মোল বলতে ওই পদার্থের যে পরিমাণে পদার্থটির প্রাথমিক কণার সংখ্যা ঠিক 6.022X1023 হয়, সেই পরিমাণকে বোঝায়। মোল হল গণনার কাজ সুবিধার জন্য ব্যবহৃত একটি একক।
ব্যাখ্যা: এক ডজন বলতে কোন জিনিসের 12টি বোঝায়। 1 ডজন পেন্সিল বলতে আমরা 12টি পেন্সিল বুঝি। তেমনি কোন যৌগের এক মোল অণু বললে 6.022X1023 সংখ্যক অনু বোঝায়। ঠিক তেমনি এক মোল পরমাণু বলতে 6.022X1023 সংখ্যক পরমাণু নির্দেশ করে।
কার্বনের পারমাণবিক ওজন = 12, কার্বনের গ্রাম-পরমাণু = 12 গ্রাম। তাহলে 12 গ্রাম কার্বনে, কার্বন পরমাণুর সংখ্যা 6.022X1023। সুতরাং 12 গ্রাম কার্বনকে এক মোল পরমাণু কার্বন বলে।
NaOH -এর আণবিক ওজন = 40; 40 গ্রাম NaOH -এর মধ্যে অণুর সংখ্যা 6.022X1023। অতএব 40 গ্রাম NaOH -কে এক মোল অণু NaOH বলা হয়।
আবার S.T.P. -তে CO2-এর আয়তন 22.4 লিটার এই পরিমাণ CO2 -এর মধ্যে অণুর সংখ্যা 6.022X1023; সুতরাং S.T.P. -তে 22.4 লিটার আয়তনের CO2 -কে এক মোল অণু CO2 বলে।
সাধারণভাবে এক মোল অণু, এক মোল পরমাণু বা এক মোল আয়ন বলতে অ্যাভোগাড্রো-সংখ্যা অর্থাৎ 6.022X1023 সংখ্যক অণু, পরমাণু বা আয়নের মোট ভর বোঝায় যাকে গ্রামে প্রকাশ করলে অণুর ক্ষেত্রে আণবিক ওজনের এবং পরমাণু বা আয়নের ক্ষেত্রে পারমাণবিক ওজনের সমান হয়। বর্তমানে ‘ গ্রাম-অণু ‘, ‘গ্রাম-পরমাণুর’ পরিবর্তে ‘মোল-অণু’, ‘মোল পরমাণু’, শব্দ ব্যবহার করা হয়।
পারমানবিক ভর একক (Atomic mass unit or a.m.u.):
প্রত্যেক পরমাণুর ওজন আছে পরমাণু এত ছোট যে পরমাণুকে সোজাসুজি তোলা তুলাদন্ডে ওজন করা সম্ভব নয় তবু প্রত্যেক পরমাণু প্রকৃত ওজন নির্ণয় করা সম্ভব হয়েছে। বর্তমানে কোন মৌলের একটি পরমাণুর ভর প্রকাশ করার জন্য পারমাণবিক ভর একক ব্যবহার করা হয়।
কোন মৌলের একটি পরমাণুর প্রকৃত ভর কে যে একক দ্বারা প্রকাশ করা হয় সেই এককে সেই একককে পারমাণবিক ভর একক বলে।
এই এককের মান হল, কার্বনের প্রধান আইসোটোপ C-12 এর একটি পরমাণুর প্রকৃত ভরের 1/12 অংশ।
এক পারমানবিক ভর = 1/12 x 1টি C-12 কার্বন পরমাণুর প্রকৃত ভর।
কার্বনের পারমাণবিক ওজন = 12
সুতরাং 1 গ্রাম কার্বন পরমাণু = 12 গ্রাম কার্বন।
অ্যাভোগাড্রো প্রকল্প অনুযায়ী, 12 গ্রাম কার্বনের মধ্যে 6.022 x 1023 সংখ্যক কার্বন পরমাণু আছে।
সুতরাং 1টি কার্বন পরমাণুর ওজন = 12 / 6.022×1023 গ্রাম।
অতএব এক পারমাণবিক ভর একক (1 a.m.u.) = 1/12 x 1টি C-12 কার্বন পরমাণুর প্রকৃত ভর।
= 1/12 X 12/6.022×1023 গ্রাম = 1.6605 x 10-24 গ্রাম।
এই হিসাবে,
1টি H পরমাণুর ভর = 1.008 a.m.u. = 1.008 x 1.6605 x 10-24 গ্রাম = 1.673 x 10-24 গ্রাম।
1টি N পরমাণুর ভর = 14 a.m.u. = 14 x 1.6605 x 10-24 গ্রাম।
1টি C পরমাণুর ভর = 12 a.m.u. = 12 x 1.6605 x 10-24 গ্রাম।
সুতরাং দেখা গেল কোন মৌলের পারমাণবিক ওজনকে এক পারমাণবিক ভর একক দিয়ে গুন করলে ওই মৌলের 1টি পরমাণুর প্রকৃত ভর পাওয়া যায়। অর্থাৎ মৌলের একটি পরমাণুর প্রকৃত ওজন = মৌলটির পারমানবিক ওজন X 1.6605 X 10-24 গ্রাম।