নিউটনের গতিসূত্র (Newton’s laws of motion):
বিজ্ঞানী নিউটন তার ‘প্রিন্সিপিয়া’ নামক গ্রন্থে তিনটি গতিসূত্র সম্পর্কে আলোচনা করেন । এই সূত্র তিনটি গতিবিদ্যার স্তম্ভস্বরূপ । সূত্রগুলো স্বতঃসিদ্ধ, এদের কোন তত্ত্বগত প্রমাণ নেই । কিন্তু পদার্থবিদ্যা ও কারিগরি বিদ্যার বহু সমস্যা এই সূত্রগুলি প্রয়োগ করে সফলভাবে সমাধান করা সম্ভব হয়েছে । এই সাফল্য সূত্রগুলোর সত্যতার প্রকৃত প্রমাণ। এগুলিই নিউটনের গতিসূত্র নামে পরিচিত। সূত্রগুলি হল-
প্রথম গতিসূত্র : বাইরে থেকে প্রযুক্ত বলের দ্বারা অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে বাধ্য না করলে, স্থির বস্তু চিরকাল স্থির অবস্থায় থাকবে এবং সচল বস্তু চিরকাল সমবেগে সরলরেখায় চলতে থাকবে ।
দ্বিতীয় গতিসূত্র : কোন বস্তুর ভরবেগের পরিবর্তনের হার বস্তুটির উপর প্রযুক্ত বলের সমানুপাতিক এবং বল যেদিকে ক্রিয়া করে ভরবেগের পরিবর্তনও সেই দিকে ঘটে ।
তৃতীয় গতিসূত্র : প্রত্যেক ক্রিয়ার একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে ।
নিউটনের প্রথম গতিসূত্রের আলোচনা: নিউটনের প্রথম সূত্র থেকে আমরা দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ধারণা পাই- (A) পদার্থের জাড্য এবং (B) বলের সংজ্ঞা ।
- পদার্থের জাড্য (Inertia of matter):
নিউটনের প্রথম গতিসূত্র থেকে আমরা জানতে পারি যে বাইরে থেকে কোন প্রভাব ক্রিয়া না করলে কোন বস্তু নিজের অবস্থার পরিবর্তন চায় না । কোন বস্তু স্থির থাকলে সব সময় স্থির অবস্থাতেই থাকতে চায় । আবার কোন সরলরেখা বরাবর চলতে থাকলে গতিশীল বস্তু সব সময় সেই সরলরেখা বরাবর সমবেগে চলতে চায় । এই মৌলিক ধর্মের দরুন বস্তু তার স্থিতি বা গতির অবস্থা পরিবর্তন করার যে কোন চেষ্টাকে বাধা দেয় । এই ধর্মকে বস্তুর জাড্য বলে ।
সংজ্ঞা : পদার্থের চেয়ে মৌলিক ধর্মের জন্য স্থির বস্তু চিরকাল স্থির অবস্থায় থাকতে চায় এবং সচল বস্তু চিরকাল সমবেগে সরলরেখায় চলতে চায় পদার্থের সেই ধর্মকে জাড্য বলে ।
পদার্থের জাড্য আলোচনা করতে গিয়ে দেখা যায় যে, বস্তুর ভর যত বেশি বস্তুটির জাড্য তত বেশি হয় । তাই কোন হালকা বস্তুর তুলনায় ভারী বস্তুকে স্থির অবস্থা থেকে সচল অবস্থায় আনতে কিংবা সচল অবস্থা থেকে স্থির অবস্থায় আনতে বেশি বল প্রয়োগ করতে হয় । অর্থাৎ ভরই জাড্যের পরিমাপক ।
জাড্য দুই প্রকার- (I) স্থিতিজাড্য ও (II) গতিজাড্য ।
(I) স্থিতিজাড্য (Inertia of rest) :
স্থির বস্তুর সব সময় স্থির অবস্থায় থাকার প্রবণতাকে স্থিতিজাড্য বলে ।
স্থিতিজাড্য সম্পর্কে ধারণা করা খুবই সহজ । আমাদের প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি যে স্থির বস্তুকে যতক্ষণ না বাইরে থেকে ধাক্কা দেওয়া হচ্ছে বা ঠেলা হচ্ছে ততক্ষণ সেই বস্তুটি একই জায়গাতে স্থির হয়ে থাকে। স্থির বস্তু কখনোই নিজে থেকে সচল হয় না ।
উদাহরণ: (i) একটি জল ভর্তি কাপ কে হঠাৎ টানলে কিছু পরিমাণ জল পিছন দিকে ছিটকে পড়ে। স্থিতিজাড্যের জন্য জল স্থির অবস্থায় থাকতে চায় বলে এরকম হয় ।
(ii) স্থির বাস হঠাৎ চলতে শুরু করলে গাড়ির মধ্যে বসে বা দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীরা পিছনের দিকে হেলে পড়ে। স্থিতিজাড্যের দরুন এরকম হয় । গাড়ি যখন স্থির ছিল তখন যাত্রীর দেহও স্থির ছিল । হঠাৎ গাড়ি চললে যাত্রীর দেহের নিম্নাংশ গাড়ির সঙ্গে সংলগ্ন বলে গতিশীল হয় । কিন্তু দেহের উর্ধাংশ স্থিতিজাড্যের দরুণ স্থির থাকতে চায়। ফলে যাত্রী পিছন দিকে হেলে পড়ে।
(iii) ধুলোবালি ছাড়ার জন্য কাপড়কে হঠাৎ জোরে ঝাঁকানো হয় । ভারী কোট বা কম্বলের ধুলো ঝাড়ার জন্য ওইগুলি ঝুলিয়ে লাঠি দিয়ে আঘাত করা হয় । ধুলোবালির কণাগুলি কাপড়ের সুতোর ফাঁকে ফাঁকে আলগা ভাবে লেগে থাকে । হঠাৎ ঝাঁকুনি দিলে বা লাঠি দিয়ে আঘাত করলে কাপড়টি গতিশীল হয় । কিন্তু স্থিতিজাড্যের জন্য ধুলোর কণাগুলো স্থির থাকতে চায় । তাই কণাগুলি কাপড় থেকে আলাদা হয়ে ঝরে পড়ে ।
(iii) জানালার কাচে ঢিল ছুড়ে মারলে কাচটি টুকরো টুকরো হয়ে যায় । কিন্তু বন্দুক থেকে গুলি ছুঁড়লে গুলিটি কাচের মধ্যে ছোট্ট ছিদ্র করে বেরিয়ে যায় । স্থিতিজাড্যের সাহায্যে এই ঘটনার ব্যাখ্যা করা যায় । জানালার কাচে ঢিল ছুড়ে মারলে বেগ কম থাকায় ঢিলটি কাচের সংস্পর্শে অপেক্ষাকৃত বেশি সময় থাকে । ফলে স্থিতিজাড্য নষ্ট হয়ে গিয়ে পুরো কাচটি আঘাতের দরুন গতিশীল হয়ে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায় । কিন্তু বন্দুকের গুলির বেগ খুব বেশি হওয়ার দরুন গুলিটি কাচের সংস্পর্শে খুব কম সময় থাকে বলে আঘাতের জায়গাটুকু ছাড়া বাকি কাচের অংশ স্থির থাকে । কেবলমাত্র আঘাতের জায়গাটুকু গতিশীল হয়ে ভেঙে যায় । তাই কাচটিতে গুলির মাপের ছোট ছিদ্র হয় । বাকি কাচ অক্ষত থাকে ।
স্থিতিজাড্য সম্পর্কিত কয়েকটি পরীক্ষা (Activity):
(a) একটি গ্লাসের উপর একটি পোস্টকার্ড রেখে পোস্টকার্ডের উপর একটি মুদ্রা রাখা হলো যাতে মুদ্রাটি গ্লাসের খোলা মুখের ক্ষেত্রফলের মধ্যে থাকে । এবার পোস্টকার্ডটিকে আঙুল দিয়ে হঠাৎ সজোরে টোকা মারলে পোস্টকার্ডটি অনুভূমিকভাবে ছিটকে বেরিয়ে যাবে কিন্তু মুদ্রাটি সোজা গ্লাসের মধ্যে পড়বে । কারণ স্থিতিজাদের দরুন মুদ্রাটি নিজের অবস্থানে স্থির থাকতে চায়, কিন্তু এর তলায় কোন অবলম্বন না থাকায় সেটি গ্লাসের মধ্যে পড়ে ।
(b) একটি উল্লম্ব দন্ডের মাথায় একটি বাটি দৃঢ়ভাবে আটকানো হল । বাটির মুখে একটি কার্ডবোর্ড রেখে এর উপর একটি বল রাখা হল । এবার একটি খাড়া স্প্রিং কে পাশের দিকে বাঁকিয়ে ছেড়ে দিলে স্প্রিংটি সজোরে কার্ডবোর্ডটিকে আঘাত করে । ফলে কার্ডবোর্ডটি দ্রুত গতিতে ছিটকে যায় । কিন্তু স্থিতিজাদের দরুন বলটি একই অবস্থানে স্থির থাকতে চায় । নিচে কোন অবলম্বন না থাকায় বলটি বাটিতে পড়বে । কিন্তু কার্ডবোর্ডটিকে হালকা ভাবে আঘাত করলে ঘর্ষণের দরুন বলটিও কার্ডবোর্ডের সঙ্গে গতিশীল হয় এবং বলটি বাটির বাইরে পড়ে ।

(II) গতিজাড্য (Inertia of motion):
সচল বা গতিশীল বস্তুর সব সময় সমবেগে সরলরেখা বরাবর চলার প্রবণতাকে গতিজাড্য বলে ।
আমরা দেখতে পাই যে, কোন বস্তুকে সচল অবস্থায় ছেড়ে দিলে বস্তুটি আস্তে আস্তে থেমে যায়, ভালো করলে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে সচল বস্তুর উপর সাধারণত সব সময় বাইরে থেকে কোনো না কোনো প্রভাব ক্রিয়া করে । যেমন একটি বস্তুকে মাটিতে গড়িয়ে দিলে মাটির সঙ্গে ঘর্ষণ, বায়ুর বাধা ইত্যাদি বল বস্তুটির বিপরীত দিকে ক্রিয়া করে এজন্য বস্তুটি থেমে যায় । এই বল গুলির প্রভাব বিভিন্ন উপায়ে কমানো যায়, কিন্তু একেবারে নির্মূল করা যায় না । যেমন একটি মার্বেল কে মাটিতে গড়িয়ে দিলে খুব তাড়াতাড়ি থেমে যায় । কিন্তু মার্বেল কে মসৃণ মেঝে বা কাচের প্লেটের উপর গড়িয়ে দিলে মার্বেলটি অনেক বেশি সময় ধরে সচল থাকে । কাজেই বাইরে থেকে ক্রিয়ারত বল সম্পূর্ণ অপসারণ করতে পারলেই কেবলমাত্র সচল বস্তু চিরকাল সচল থাকতে পারে । বাস্তবে এই ধরনের গতি দেখতে পাওয়া যায় না; মহাশূন্যে নক্ষত্রের গতিকে প্রায় বাধাহীন বলা যায়, কারণ সেখানে কোন জড় মাধ্যম নেই ।
গতিজাড্যের উদাহরণ:
(i) চলন্ত গাড়ি হঠাৎ থামলে যাত্রীরা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে । গতিজাড্যের জন্য এরকম হয় । চলন্ত গাড়িতে যাত্রীর সম্পূর্ণ দেহই গতিশীল ছিল । গাড়িটি থামবার সঙ্গে সঙ্গে যাত্রীর দেহের নিম্নাংশ গাড়ির সংলগ্ন বলে স্থির হয়ে যায় । কিন্তু দেহের উপরের অংশ গতি জরদের দরুন গতি বজায় রাখতে চেষ্টা করে । ফলে যাত্রীরা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে বা অসাবধান থাকলে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায় ।
(ii) লং জাম্প দেওয়ার আগে প্রতিযোগীরা কিছু দূর থেকে দৌড়ে এসে লাভ দেন । কারণ দৌড়ানোর জন্য প্রতিযোগী যে গতি লাভ করেন গতিজাড্য তা বজায় রাখতে চায় ফলে বেশি দূরত্ব অতিক্রম করে ।
(iii) একটি ঘুরন্ত বৈদ্যুতিক পাখার সুইচ বন্ধ করার পরেও পাখাটি সঙ্গে সঙ্গে স্থির হয়ে যায় না কিছুক্ষণ ঘুরতে থাকে । কারণ সুইচ বন্ধ করে দেবার পরেও গতিজাড্যের জন্য পাখাটি গতি বজায় রাখতে চায় । তাই আরো কিছু সময় ঘোরার পর পাখাটি স্থির হয় ।
(iv) দৌড় প্রতিযোগিতায় প্রতিযোগীরা সীমারেখায় পৌঁছবার সঙ্গে সঙ্গে থেমে যেতে পারেন না, আরো কিছুদূর এগিয়ে যান । সীমারেখায় পৌছাবার সঙ্গে সঙ্গে থামবার চেষ্টা করলেও প্রতিযোগীর দেহ গতিজাড্যের দরুন গতি বজায় রাখতে চায় বলেই এরকম হয় । একই কারণে সাইকেল চালাতে চালাতে আরোহী প্যাডেল করা বন্ধ করলেও সাইকেলটি গতিজাড্যের দরুন আরও কিছুদূর এগিয়ে যায়।
(v) সমবেগে চলন্ত কোন গাড়ির যাত্রী একটি বলকে সোজা উপরে ছুড়ে দিলে বলটি আবার তার হাতে এসে পড়ে । কারণ উপরের দিকে ছুড়ে দিলেও গতিজাড্যের জন্য বলটি গাড়ির বেগেই সামনের দিকে এগিয়ে যায় । তাই বলটি আবার যাত্রীর হাতেই পড়ে ।
কিন্তু এই সময়ের মধ্যে গাড়ির বেগ পালটে গেলে বলটি যাত্রী হাতে এসে পড়বে না । গাড়ির ত্বরণ হলে বলটি যাত্রীর পিছনে, আর মন্দন হলে যাত্রীর সামনে পড়বে ।
গতিজাড্য সম্পর্কিত পরীক্ষা (Activity):
(a) একটি কাঠের ব্লককে সামনে রেখে জলভর্তি একটি কাপকে সম বেগে ব্লকের দিকে ঠেলে দেওয়া হল । দেখা গেল ধাক্কা লেগে কাপটি থেমে গেল কিন্তু কিছু পরিমাণ জল সামনের দিকে ছিটকে পড়ে । গতিজাড্যের দরুন এরকম হয় ।
(b) একটি খেলনা গাড়ির উপরে একটি ভারী বল রাখা হলো । গাড়ির সম্মুখে একটি দৃঢ় বাফার রাখা হলো । গাড়িটিকে সমবেগে চালালে বলটি গাড়ির স্থির থাকে । গাড়িটি বাফারের সঙ্গে ধাক্কা লেগে থেমে যায় । কিন্তু গতিজাড্যের দরুন বলটি সামনের দিকে গতি বজায় রাখে এবং বাফারটিকে অতিক্রম করে সামনের গিয়ে পড়ে ।

জাড্য এবং ভর : একটি সাইকেলকে সহজে ঠেলে নিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু একটি মোটরসাইকেলকে ঠেলে নিয়ে যাওয়া খুবই কষ্টকর । একটি লরিকে একা ঠেলে নড়ানো অসম্ভব । আবার একটি চলন্ত সাইকেলকে পিছন থেকে টেনে সহজে থামানো যায়, কিন্তু একই বেগে চললেও একটি লরিকে এমন ভাবে থামানো অসম্ভব । একটি খালি লরিকে ব্রেক করে সহজে থামানো যায় । কিন্তু একটি মালভর্তি লরিকে একই বেগে চললেও অত সহজে থামানো যায় না । লাথি মেরে ফুটবলকে সচল করা যায় । কিন্তু একই আকারে লোহার বলকে এভাবে সচল করা যায় না । এই উদাহরণ গুলি থেকে বোঝা যায় যে বস্তুর ভর যত বাড়ে তার স্থিতি বা গতির অবস্থা পরিবর্তন করা তত বেশি কষ্টকর । অতএব বস্তুর ভর যত বেশি হয় বস্তুর যারডাও তত বেশি হয় অর্থাৎ ভরই যাদের পরিমাপ ।
- বলের সংজ্ঞা (Definition of force) :
নিউটনের প্রথম গতিসূত্র থেকে আমরা ‘বল’ সম্পর্কে ধারণা করতে পারি । স্থির বস্তু চিরকাল স্থির থাকতে চায় আর সচল বস্তু চিরকাল সমবেগে সরলরেখা ধরে চলতে চায় । কাজেই যদি কোন স্থির বস্তু সচল হয় অথবা কোন সচল বস্তুর বেগ বাড়ে বা কমে বা বস্তুর গতির অভিমুখ পালটে যায়, তাহলে আমরা সিদ্ধান্ত করতে পারি যে বাইরে থেকে কোন প্রভাব বস্তুটির উপর ক্রিয়া করেছে । বাইরে থেকে ক্রিয়ার এই প্রভাবকে ‘ বল ‘ বলে । সুতরাং কোন বস্তুর স্থিতি বা গতির অবস্থার পরিবর্তন কেবলমাত্র বাইরে থেকে বল প্রয়োগ করেই করা যায় ।
সংজ্ঞা : বাইরে থেকে যা প্রয়োগ করে কোন বস্তুর স্থির বা গতিশীল অবস্থার পরিবর্তন করা হয় বা পরিবর্তন করার চেষ্টা করা হয় তাকেই বল বলে ।
বলের মান ও অভিমুখ দুই-ই আছে তাই বল একটি ভেক্টর রাশি ।